ভূমিকম্প নিরোধক মাটির ঘর

 এ পাড়া ও পাড়া যেখানেই যাওয়া যায়, চোখ আটকে যায় ঘরগুলোতে। সবই মাটির তৈরি, পাকা পথের ধারে উঁকি দিচ্ছে। এ যেন ছোটবেলায় পড়া 'ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি'। গ্রামের নাম বেরাইদ। অবস্থান ইট-পাথরের 'জঞ্জাল' ঢাকা মহানগরীর মধ্যেই।


রাজধানীর বাড্ডা হয়ে সাঁতার কূল ইউনিয়ন পেরোলেই বেরাইদ ইউনিয়নের বেরাইদ গ্রাম। একসময় মেঠো পথ ছিল। এখন পাকা। তবু পাশেই আছে কাশবন, আছে কুলকুল বহমান নদী বালু, আর আছে কয়েকটি খাল। বাড্ডার পর পার হয়ে দুটো বড় বাজার পেরোলেই হাতছানি দেয় বেরাইদ। বেরাইদ গ্রামে প্রায় তিন হাজার পরিবারের বাস। এর মধ্যে ২০০ থেকে ২৫০টি পরিবার থাকে মাটির ঘরে। মাটির ঘরগুলোর বেশির ভাগই ১০০ থেকে ২৫০ বছরের পুরনো। এত বছরে ছোটখাটো ভূমিকম্প অনেকবার হয়েছে। তবে ঘরগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি।


অর্থের অভাবে গ্রামবাসী মাটির ঘরে থাকেন এমন নয়। গ্রামের অনেক সচ্ছল পরিবারও মাটির ঘরেই আছেন সুখে-শান্তিতে।


 আড়াইদ্দাপাড়া যাওয়ার পথে একটি দোতলা মাটির ঘরে দেখা মেলে শতবর্ষী জামিরুল বেগমের। ১২ বছর বয়স থেকে এখানে তিনি আছেন। স্বামী শাহজাদা খলিফা বেঁচে নেই। তিনিও এ ঘরে থাকতেন। এ ঘরেই জীবন কাটিয়েছেন জামিরুলের শ্বশুর আবদুল খলিফা। তিনি নদীতে নৌকায় করে কাপড় বিক্রি করতেন। সেই অর্থ দিয়েই ঘরটি বানিয়েছিলেন। 'এমন শান্তির ঘর কোথাও পাইবা না। গরমে কম গরম লাগে। শীতে শীত কম লাগে। এ ঘরের মায়ায় বাঁইচা আছি। এ ঘরেই মরুম।' বলেন জামিরুল। তাঁর মুখে হাসি। 'পাকা ঘর বানিয়ে দিলে কি এই মাটির ঘরটা ছাড়বেন'_এ প্রশ্নে তিনি নিরুত্তর থাকেন। শতবর্ষী জামিরুলের মতো গ্রামের অনেকের প্রশান্তির ঠিকানা এই মাটির ঘর।


গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এসব মাটির ঘর নষ্ট হচ্ছে না, ভেঙে পড়ছে না। গ্রামবাসী জানান, নিয়মিত যত্ন নিলেই মাটির ঘর টিকে থাকে বছরের পর বছর। বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে ৯৯ শতাংশ গ্রামবাসীর মাটির ঘর ছিল। ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যায় অনেক ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। তবে নতুন করে মাটির ঘর খুব একটা তোলা হচ্ছে না বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান বলেন, মাটির ঘর নিয়ে এ প্রজন্মের অনেকের মধ্যে উৎসাহের হয়তো অভাব রয়েছে। তবে বড়রা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চান।


বেরাইদ গ্রামটিকে অনেকে মসজিদের গ্রাম বলেন। গ্রামে আছে ১২টি প্রাচীন মসজিদ। এর মধ্যে সাতটিই পুরনো শত বছরের। আছে ৪০০ থেকে ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদও। পুরনো স্থাপত্যের ভুঁইয়া পাড়া জামে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এরই মধ্যে সংরক্ষণ শুরু করেছে। শিক্ষাদীক্ষায় গ্রামবাসী গর্ব করতে পারেন। গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই চোখে পড়ে এক এক করে পুরনো-নতুন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেরাইদ গ্রাম ও মসজিদের ইতিহাস সন্ধানে একনিষ্ঠ কর্মী গ্রামের এমদাদ হোসেন ভুঁইয়া জানান, গ্রামে কম হলেও সাড়ে চার হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে।

 

বেরাইদ গ্রামটি ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম। ৯টি ওয়ার্ডের আটটিই এ গ্রামে। ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়নে কম পক্ষে ২৫ হাজার লোকের বাস। এর মধ্যে বেশির ভাগই বেরাইদ গ্রামের। গ্রামের পাড়া গুলোর নামও মজার মোড়ল পাড়া, পূর্বপাড়া, ভুঁইয়া পাড়া, চীনাদি, আড়াইদ্দা পাড়া, আগার পাড়া, আশকাটেক। সব পাড়ায়ই মাটির ঘর।

 

মোড়ল পাড়ার ফজলুল হক, আবদুল ওয়াহেদ, হামিদুল হক, সাবিনা ইয়াসমিন ও অন্যরা জানান, তাঁদের অনেকের দাদার আমলে এ মাটির ঘর তৈরি হয়। এসব ঘর তৈরি হয় লাল ও সাদা রঙের বিশেষ ধরনের মাটি দিয়ে। ভেতরের অংশে লাল মাটি ও বাইরের অংশে সাদা মাটির গভীর প্রলেপ দেওয়া থাকে। গ্রামটি বালু নদের পারেই। বালু নদটি পাড়ি দিলেই ওপারে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ। রূপগঞ্জের নাওরা ও বরুণাসহ বিভিন্ন গ্রামে ঘর তৈরির লাল মাটি পাওয়া যায়। ওখান থেকেই আনা হয় মাটি। বেরাইদ গ্রামে অবশ্য সাদা মাটি পাওয়া যায়।


গ্রামবাসী বলেন, মাটির ঘরের চারদিকের দেয়াল কমপক্ষে ১৮ ইঞ্চি পুরু হয়। সাধারণত ১৪ হাত দৈর্ঘ্য, ১০ হাত প্রস্থ এবং ১০ হাত দৈর্ঘ্য, সাত হাত প্রস্থের ঘর তোলা হয়। একটি ঘর তুলতে সাধারণত ছয় মাস লাগে। ব্যয় হয় ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। বর্ষাকালে নির্মাণ শুরু করলে তা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায় বলে শীত মৌসুমেই এ ধরনের ঘর নির্মাণ করা হয়।

 

মোড়লপাড়ায় মূল সড়কের পাশেই হুমায়ুন কবীরের মাটির ঘর। স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে ছিমছাম সংসার। হুমায়ুন কবীর একটি কুরিয়ার সার্ভিসের বনানী কার্যালয়ে কাজ করেন। তিনি জানান, তাঁর বাবা আবুল কাশেম ঘরটি তৈরি করেছিলেন। ঘরটির বয়স কমপক্ষে ১০০ বছর হবে। পাশেই মাটির আরো একটি ঘর তাঁর চাচা আবুল হোসেনের। এটির বয়স তারও বেশি। কবীর ও তাঁর স্ত্রী উম্মে কুলসুম জানান, তিনিও একই এলাকায় বাবার বাড়িতে বড় হয়েছেন মাটির ঘরে

 

ভূমিকম্প নিরোধক মাটির ঘর তৈরির প্রযুক্তি


 


ভূমিকম্প নিরোধক মাটির ঘর তৈরি করে সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন গবেষক অজিত রায়। দিনাজপুর সদর উপজেলার ২নং সুন্দরবন ইউনিয়নের উত্তর সুন্দরবন গ্রামে অল্প খরচে পরিবেশ বান্ধব, টেকসই, মজবুত ও ভূমিকম্প নিরোধক এবং দীর্ঘ স্থায়ী একাধিক মাটির ঘর তৈরি করে দিয়েছেন সুন্দরবন গ্রামের প্রয়াত কবি হরিপদ রায়ের ছেলে গবেষক অজিত রায়। সুন্দরবন গ্রাম এখন পরিবেশবান্ধব গ্রামে পরিণত হয়েছে।


অজিত রায়ের ফর্মুলায় মাটির ঘর তৈরির গবেষণা সম্প্রতি দেশ-বিদেশে প্রকৌশল বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ইতিমধ্যে তার গবেষণা ব্রিটেনের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অফ্রেটার প্রত্যক্ষ সমর্থনে ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) গবেষণার কাজে স্থান পেয়েছে। তার নির্মাণ করা ঘর দেখার জন্য বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনার সমপ্রতি দিনাজপুরে আসেন।

 

এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে ইউকের হাউজিং অ্যান্ড হ্যাজার্ড গ্রুপ ও রেডার এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সংস্থা সেফ ও ব্রিফ। অজিত রায়ের গবেষণায় গত দুই বছরে দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন গ্রামের একাধিক গরিব পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে পরিবেশ বান্ধব মাটির ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। 


অজিত রায় জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে মাটির ঘর তৈরিতে শুধু পানিতে কাদার দলা তৈরি করে সারিবদ্ধভাবে গেঁথে দেয়া হত। কাদা শুকিয়ে গেলে ৫-৭ দিন পর আবার নতুন সারি গেঁথে তৈরি করা হত ঘরের দেয়াল। 


এভাবে তৈরিকৃত মাটির ঘর বন্যায় ভেঙে যেত। ইঁদুর ও উইপোকায় মাটির দেয়াল কেটে গর্ত করে দিলে তা ভেঙে পড়ত। কাদা মাটির পরিবর্তে শুকনো ঝরঝরে মাটি, খর ও ৫% সিমেন্ট মিশিয়ে ব্লক(block)তৈরি করে দুরমুজ দিয়ে পিটিয়ে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান সম্মত পরিবেশ বান্ধব টেকসই ঘর নির্মাণ করেছেন অজিত রায় । 


বর্তমানে দিনাজপুর শহরের জগেন বাবুর মাঠে মাটির ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। অজিত রায়ের নেতৃত্বে দিনাজপুর সদরের সুন্দরবন গ্রামে পরিবেশবান্ধব ঘর নির্মাণ কাজ সমপ্রতি শেষ হয়েছে। নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছেন দিনাজপুরের ২৫ জন ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচার বিভাগের শেষ বর্ষের ৮ জন শিক্ষার্থীসহ ব্রিটেনের একজন গবেষক এবং ১৩ জন প্রকৌশলী। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর গ্রামে যখন বিলুপ্ত হতে চলছিল ঠিক সেই সময় অজিত রায়ের গবেষণাকৃত পরিবেশ বান্ধব মাটির ঘর দেখে আবারও গ্রামে মাটির ঘর তৈরির ধুম পড়েছে। 



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...