আদর্শ খামার - আধুনিক প্রযুক্তির

গ্রামের নাম ডেবরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। এর ওপর নেই বিদ্যুৎ। সুবিধাবঞ্চিত এই অজপাড়াগাঁয়েই এক যুবক গড়ে তুলেছেন আধুনিক প্রযুক্তির আদর্শ খামার। জেনারেটর, সোলার প্লান্ট, বায়োগ্যাস, ক্রাশার মেশিন, তাপমাত্রা নির্ণয় যন্ত্র ও সাপ্লাই মোটর- প্রযুক্তির নানা উপকরণ তাঁর হাতের মুঠোয়।

 

উদ্যোগী এই যুবকের নাম মিজানুর রহমান মাসুদ। তাঁর গড়ে তোলা হাঁস-মুরগি, কবুতর ও ছাগলের আদর্শ খামার হয়ে উঠেছে দৃষ্টান্ত। প্রশংসা কুড়িয়েছেন গ্রাম ছাড়িয়ে পুরো ঝালকাঠি জেলায়। শত শত মানুষ নলছিটির অবহেলিত এই গ্রামে আসছে শুধুই মাসুদের আদর্শ খামার দেখতে। অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মকর্মসংস্থানে এগিয়ে আসছেন এমনই কিছু করার মানসে।

 

খামারে পশু পালন : গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমে ৪০টি যমুনাপারি ছাগল নিয়ে খামার গড়ে তোলেন মিজানুর রহমান মাসুদ। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছাগলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০।  ৭০ শতাংশ জমিতে গড়ে তোলেন 'শাফিন আদর্শ খামার'।

যমুনাপারি ছাগল বছরে দুই বার তিন থেকে চারটি করে বাচ্চা দেয়। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রায় চার লিটার করে দুধ দেয় প্রতিটি ছাগল। আরেকটি খামারে পালন করা হচ্ছে হাঁস-মুরগি ও কবুতর। এখানে রয়েছে খাকি কেম্বেল নামে পরিচিত ৫০০ হাঁস, ২০০ কবুতর এবং ১০০ মুরগি। হাঁসগুলো টানা ছয় মাস ডিম দেয়। হাঁস পালনের জন্য ছাগলের খামারের পাশেই রয়েছে লোহার বেষ্টনী দেওয়া খোলা মাঠ। থাকার জন্য রয়েছে বড়সড় একটি ঘর। একই ঘরে ওপরের দিকে রয়েছে কবুতরের ঘর। পাশাপাশি রয়েছে দেশীয় জাতের শতাধিক মুরগি। রয়েছে বিদেশি ফাইটার মুরগিও। তুষ পদ্ধতিতে খামারের হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে। এসব বাচ্চা বড় হচ্ছে খামারেই। বাড়ছে হাঁসের সংখ্যা। একই সঙ্গে বাচ্চাগুলোর গ্রাহক চাহিদাও রয়েছে বেশ। বিষয়টি বেশ সাড়া জাগিয়েছে।

 

ঘাস চাষ : খামারের পাশেই পাঁচটি খণ্ড খণ্ড জমিতে চাষ করা হচ্ছে নেপিয়ার জাতের ঘাস। দেখলে মনে হবে ঘাসের বাগান। মাসুদ জানান, ছাগলের খাবার হিসেবে সাভারের সেন্ট্রাল ডেইরি খামার থেকে ঘাসের 'কাটিং' (বীজ) সংগ্রহ করে এখানে চাষ করছেন। বৃষ্টির মৌসুমে অনেক সময় ঘাস কম জন্মায়। তাই শুকনো মৌসুমে ঘাসগুলো কেটে 'হে' (শুকনো) করে রাখা হয়। এগুলো পানিতে ভিজিয়ে খাওয়ানো যায়। এটা গরু-মহিষও খেতে পারে। এ জন্য মাসুদকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ডেবরা গ্রামের অনেকেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগও ঘাস চাষের তিনটি প্রদর্শনী প্লট তৈরি করে দিয়েছে।

 

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুতের অভাব মাসুদের কাছে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি এগিয়েছেন বিকল্প পথে। জেনারেটর, সোলার প্লান্ট ও বায়োগ্যাসের সহায়তায় তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, চালাচ্ছেন ক্রাশার মেশিন ও সাপ্লাই মোটরের মতো আধুনিক প্রযুক্তি। খামারে বসেই নিজস্ব মেশিনে ভুট্টা, গম ও ডাল ভাঙানো ছাড়াও রয়েছে ঘাস কাটার মেশিন। এসব মিলিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পশু-পাখির খাবার। রয়েছে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র। তাপমাত্রা নির্ণয় করে অনেক সময় শীতে পশুকে গরম পোশাক পরানো হয়। সপ্তাহে দুই বার ওষুধ স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত রাখা হয় খামারটি। খামারে তিনজন শ্রমিকের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা শ্রম দিচ্ছে। শ্রমিক মিন্টু মাঝি বলেন, 'আমরা বেকার ছিলাম। গ্রামে বসে কিছু করে জীবিকার সুযোগ মিলবে ভাবতেও পারিনি। মাসুদ ভাইয়ের আধুনিক প্রযুক্তির খামার আমাদের কাজের জায়গা করে দিয়েছে।'

 

প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহযোগিতা : সপ্তাহে দুই-তিন দিন খামারের পরিস্থিতি দেখতে ছুটে যান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. পলাশ সরকার। এ ছাড়া খামারের মালিক অথবা শ্রমিকরা কেউ সমস্যায় পড়ে জরুরি ফোন করলে নিজে অথবা অফিসের স্টাফ পাঠিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। কম মূল্যে খামারের পশুপাখির জন্য দেওয়া হচ্ছে ওষুধ।

 

উদ্যোক্তা যা বলেন : শুধু লাভের আশায় নয়, শাফিন আদর্শ খামারটি গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য হলো এলাকার বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করা। খামারের উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান মাসুদ বলেন, 'আমি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করি। এলাকায় আমার দুই ভাই বেকার। তাদের পাশাপাশি এলাকার বেকার যুবকদের কথা চিন্তা করে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এমন খামার গড়ার উদ্যোগ নিই। মাত্র দেড় বছরেই সাফল্য আসায় এবার খামারটি সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা নিয়েছি, যাতে করে আরো লোকের কর্মসংস্থান করা যায়। আর কেউ স্ব-উদ্যোগে এমন কিছু করতে চাইলে সাধ্যমতো সহায়তা করব। প্রতিবেশী হেলাল উদ্দিন বলেন, খামারটির কলেবর বাড়লে এখানে অনেক শ্রমিক কাজ করতে পারবে। এমন আরো কয়েকটি খামার গড়ে উঠলে স্থানীয়ভাবেই জেলার দুধ ও ডিমের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...