সবজি চাষ

                                                                                                

পবা উপজেলার বড়গাছি খাঁপাড়ায় কঠোর শ্রমে ফলানো সবজি দেখাচ্ছেন চাষি আবদুর রহমান।

 

 

                   ।  নিচে উল্লেখিত বিষয় থেকে স্থানীয়রা ধারনা নিয়ে সবজি চাষ করতে পারেন

 

 

সবজি চাষে পবাবাসীর বিপ্লব

 

রাজশাহী

 

মাচার ওপরে সবুজ ফসলের লতাপাতাগুলো লেপ্টে আছে। আর মাচার নিচে মাটির দুই থেকে আড়াই ফুট উঁচুতে ঝুলছে লাউ, করলা, বরবটি, চালকুমড়া, শসা, ঝিঙা, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া- হরেক সবজি। যেদিকে তাকানো যায় কেবলই নজরে পড়ে মাচায় ঝোলানো লতাজাতীয় সবজির ক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে যায়। এসব ক্ষেতের মধ্যে কোনো কোনো জমিতে কৃষক রয়েছেন পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউবা মাচা থেকে সবজি তুলছেন। এরকম দৃশ্য চোখে পড়ে রাজশাহীর পবা উপজেলার গ্রামগুলোতে।


পবার বড়গাছি, বড়গাছি খাঁপাড়া, নওহাটা, কালুপাড়া, দাদপুর, শ্রীপুর, সবসার, খুঁটিপাড়া, টিকরিপাড়া, মদনহাটি, বাগধানি, বাগসারাসহ বিভিন্ন গ্রামের আবাদি জমিগুলোতে কেবলই সবুজের সমারোহ। এখানকার সবজি ক্ষেত দেখে প্রথমেই ধারণা হবে, এ যেন সবজি চাষের বিপ্লব শুরু হয়েছে। কেবল বড়গাছি গ্রামেই এ বছর প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে মাচায় সবজি চাষ হয়েছে।


স্থানীয় উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, রাজশাহীতে উৎপাদিত সবজির বেশির ভাগই চাষ হয় পবার গ্রামগুলোতে। আর এগুলোর বেশির ভাগই চাষ হয় মাচার মাধ্যমে।


রাজশাহী জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পবা উপজেলার বেশির ভাগ কৃষক এখন মাচায় লতাজাতীয় সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। উপজেলার অন্তত ৯৫ ভাগ কৃষক এখন মাচায় সবজি চাষ করেন। বাম্পার ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় এই পদ্ধতিতে সবজি চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। পবাবাসীর সাফল্য দেখে জেলার মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা, পুঠিয়া, বাঘা, তানোর, গোদাগাড়ী ও চারঘাট উপজেলায়ও মাচায় সবজি চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এবার জেলার ৯টি উপজেলায় মাচায় সবজি চাষ হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে পবায় রয়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ হেক্টর জমি।


পবা উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা আশিষ কুমার মুকুট চলতি বছরে পবা উপজেলায় বিভিন্ন সবজি আবাদের খাতওয়ারি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা ফারজানা তানজিনার মাধ্যমে জানা যায় পুরো জেলায় সবজি আবাদের সার্বিক চিত্র।


এক মাচাতে তিন ফসল :

পবার দাদপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলামের আট কাঠা জমিতে মাচার নিচে ঝুলে আছে শ দেড়েক বড় বড় লাউ। এগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় তিন হাজার টাকা। এই জমি থেকে এ বছর প্রায় সাত হাজার টাকার লাউ বিক্রির আশা করছেন শহিদুল। এর আগে ওই জমিতে তিনি চাষ করেন বরবটি। তাতে আয় হয়েছে ৯ হাজার টাকা। বরবটির মাচাতেই লাউ চাষ করেছেন। এবার লাউগাছ মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই মাচায় আবাদ করবেন শসা। এক মাচায় তিন ফসল আবাদ করতে পারায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অঙ্কের খরচ কমে গেছে। বেড়েছে লাভের অঙ্ক।


সবসার এলাকার কৃষক আশাদুল জানান, তিনি এ বছর প্রায় ১২ কাঠা জমিতে পটোল চাষ করেছেন। এরই মধ্যে প্রায় আট হাজার টাকার পটোল বিক্রি করেছেন। আগামী দেড়-দুই মাসে তিনি আরো প্রায় ছয় হাজার টাকার পটোল বিক্রি করতে পারবেন। পটোল শেষ হওয়ার পর একই মাচায় লাউ আবাদ করবেন তিনি। তাতেও আয় হবে সাত থেকে আট হাজার টাকা। লাউ চাষের জন্য ইতিমধ্যে চারাও রোপণ করা হয়েছে ওই জমিতে। লাউ শেষে ওই জমিতে চাষ করা হবে শিম।


আয় বেশি খরচ কম : বড়গাছি খাঁপাড়া গ্রামের একটি বিলে
নিজের করলার জমিতে সবজি ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন কৃষক আবদুর রহমান। তিনি জানান, এ বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে করলা চাষ করেছেন। প্রথম চালানের করলা বিক্রি করে তিনি প্রায় ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। রোপা আমন চাষের জন্য জমি প্রস্তুতের আগ পর্যন্ত তিনি আরো প্রায় এক লাখ টাকার করলা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। অথচ পাঁচ বিঘা জমিতে করলা চাষ করতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। করলা চাষ শেষে মাচা ভেঙে ফেলে সেই জমিতে আবার রোপা আমন আবাদ করবেন। আবার কোনো জমিতে চাষ করা হবে মুলা। আমন বা মুলা তুলে শীত মৌসুমে চাষ করা হবে আলু।


আবদুর রহমান আরো জানান, গ্রামের অন্যদের দেখে তিনি প্রায় দুই বছর আগে মাচায় সবজি চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই মাত্র এক বিঘা জমি থেকে তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার করলা বিক্রি করেন। এরপর থেকে তিনি প্রতিবছর মাচায় সবজি চাষ করছেন। লাভও পাচ্ছেন ভালো।


ক্ষেতেই ফসল বিক্রি : বড়গাছি গ্রামের কৃষক মিঠু জানান, রাস্তার পাশে জমি হলে সবজি সংগ্রহ করার পর জমিতেই তা বিক্রি হয়ে যায়। গ্রামের বিভিন্ন মোড় বা হাটবাজারে সবজি কেনাবেচা হয় ব্যাপক হারে। তবে বেশি বিক্রি হয় জমি বা গ্রামেই। জমি থেকে কোনো মতে সবজি সংগ্রহ করে রাস্তার ওপর নিয়ে এলেই হলো। সেখানেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এসব। আর এসব সবজি কেনার জন্য পবার বিভিন্ন গ্রাম চষে বেড়ান অন্তত ৮০ জন পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী। কৃষকদের কাছ থেকে সবজি কিনে তাঁরা ট্রাকে করে নিয়ে যান ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।


পবার মোদনহাটি গ্রামে করলা কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী আজিত জানান, তিনি প্রতিদিন অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ মণ সবজি গ্রাম থেকে কিনে নেন। তাঁরা কয়েকজন দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সবজি কিনেন। আর মাচায় চাষ করা সবজির রং সুন্দর এবং তা সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে কাটতি বেশি।


বেকারত্ব দূর :

বড়গাছি খাঁপাড়া এলাকার মফিজ উদ্দিনের ছেলে রেজাউল করিম এশিয়ান ইউনিভার্সিটি রাজশাহী ক্যাম্পাস থেকে স্নাতক পাস করেছেন। তিনি জানান, এসএসসি পাস করার পরই চাকরির আশায় না ঘুরে বাবার সম্পত্তিতে ফসল ফলানো শুরু করেন। প্রথম বছরেই মাচায় ঝিঙা চাষ করে ভালো আয় পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রেজাউলকে। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরো দুই ভাই। শুধু রেজাউলরা তিন ভাই নন, মাচায় সবজি চাষ করে এলাকার শত শত যুবকের বেকারত্ব দূর হয়েছে।


শুরুর কথা: কৃষি কর্মকর্তা আজিমুদ্দিন জানান, প্রায় আট বছর আগে উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে বড়গাছি বাজার এলাকার জনৈক আলমগীর তিন শতক জমিতে বরবটি চাষ করেন। প্রথম বছরেই মাচায় বরবটি চাষ করে তিন শতক জমি থেকে তিনি দুই হাজার টাকা আয় করেন। এরপর থেকেই পবায় মাচায় সবজি চাষে বিপ্লবের শুরু।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...