আমের গুটিঝরা রোগ প্রতিরোধে করণীয়

বাংলাদেশে আম হলো ফলের রাজা এবং আম গাছ হলো জাতীয় গাছ। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে আম জন্মে কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চলে এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। আম চাষিরা প্রতি বছর অনেক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন রোগ ও পোকামাকড় আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্চা ও রোগ-পোকামাকড় দমনে করণীয় নিয়ে বিশেষ ফিচার লিখেছেন কৃষিবিদ এম এ মজিদঃ

 

() ফলন্ত আমগাছের পরিচর্যাঃ


অফল ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ফলন বাড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত পরিচর্যাগুলো করা  প্রয়োজনঃ

 

পরগাছা দমন : আমগাছে একাধিক জাতের আগাছা জন্মাতে দেখা যায়, যা গাছের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর। পরগাছাগুলোয় শিকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া হয়, যা গাছের মধ্যে প্রবেশ করে রস শোষণ করে খায় এবং দুর্বল করে। পরগাছার পাদুর্ভাব বেশি হলে গাছের পাতার আকার ছোট হয় ও ফ্যাকাসে হয় এবং অনেক সময় গাছ মারা যায়। এর ফলে গাছের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই পরগাছা অপসারণ করতে হবে।

 

সার প্রয়োগ : গাছের বৃদ্ধি ও ফল উৎপাদনের জন্য সারের ব্যবহার দরকার। ফলন্ত গাছের আকার, বয়স ও মাটির উর্বরতার ওপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। দুপুর বেলা যতটুকু স্থানে ছায়া পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কুপিয়ে সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

 

সেচ প্রয়োগ : জমির ওপর স্তরে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান থাকে বা সার হিসেবে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয় তাই আমবাগানের ওপরের দু-তিন মিটার অংশকে জমির পানি সংরক্ষণ স্তর হিসেবে ধরা হয়। তাই শুষ্ক মওসুমে আমবাগানে পানি সেচ দেয়া দরকার। আমের গুটি মটরদানার মতো হওয়ার পর থেকে ১৫-২০ দিন পরপর দু-তিনবার সেচ দিলে আমের গুটিঝরা বন্ধ হয়।

 

বয়স্ক টক আমগাছকে মিষ্টি আমগাছে রূপান্তরকরণ : বাগানের কোনো গাছের আমের গুণাগুণ খারাপ হলে সে গাছকে নষ্ট না করে ভিনিয়ার কলমের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করা য়ায়। বয়স্ক গাছের দু-তিনটি ডাল কেটে দিলে সেখান থেকে নতুন শাখা বের হলে তারপর নতুন শাখাতে ভিনিয়ার কলম করে নিতে হবে। এ ভাবে তিন-চারবারে কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

 

পুরনো বাগান নবায়ন : আমবাগানের বয়স বেশি হলে ফল ধারণ কমে যায়, তাই এ ক্ষেত্রে গাছ কেটে না ফেলে পুরনো গাছের ভারী শাখা কেটে দিলে সেখানে নতুন শাখা বের হবে এবং গাছ নবায়ন হয়ে যাবে। এ ভাবে দু-তিন বছরে বাগান নবায়ন করা যায়।

 

ফসল সংগ্রহ : ফল ধরার তিন-পাঁচ মাসের মধ্যেই জাতভেদে ফল পাকা শুরু করে। বাণিজ্যিকভাবে কখনো সম্পূর্ণ পাকা আম গাছ থেকে পাড়া ঠিক নয়। গাছের ফল দু-চারটি পাকা শুরু করলে বাঁশের কোটার মাথায় থলেসদৃশ জালতি লাগিয়ে আম পাড়তে হবে যেন আঘাত না লাগে। নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখে ফল সংগ্রহ করতে হবে : (১) আমের বোটার নিচে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে, (২) পানিতে দিলে ডুবে যাবে, (৩) কষ বের হলে দ্রুত শুকে যাবে ও (৪) দু-একটি পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে।

 

ফল সংরক্ষণ : আম পচনশীল ফল। বেশি পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করলে সংরক্ষণকাল কম হয়। বেশির ভাগ জাতের আম ১৩-১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আদ্রতায় বাঁশের ঝুড়ি, বাস্কেট, খড়বিছানো প্রভৃতিতে স্থানে চার-সাত সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়।

 

() রোগ দমনঃ

 

অ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose) : এ রোগ আমের পাতা ও ফলে হয়ে থাকে। এটা কোলিটোর্টিকাম গোলেসপোরিওডিস (Colletotrichum gloeosporioides) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগের কারণে আমের ফলন শূন্যের কাছাকাছি আসতে পারে।

 

লক্ষণ : (১) এ রোগ নতুন পাতা, পুষ্পমঞ্জরী ও ফলে দেখা যায়। (২) পাতায় ধূসর-বাদামি ছোট কৌষিক দাগ পড়ে এবং পরে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে ও একপর্যায়ে পাতা ঝরে পড়ে। (৩) ফলের ওপর প্রথমে গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে। (৪) দাগগুলো পরে বড় হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে। (৫) আক্রমণ মারাত্মক হলে পরে সম্পূর্ণ আম পচে যায়।

 

অনুকূল অবস্থা : (১) তাপমাত্রা ২৫-২৮ ডিগ্রি সে.। (২) আপেক্ষিক আদ্রতা ৭০-৮০%। (৩) অধিক বৃষ্টিপাত। (৪) ঘন কুয়াশা ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়।

 

দমনব্যবস্থা : (১) ফল সংগ্রহের পর বাগানের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে। (২) স্বাস্থ্যবান গাছ রোপণ করতে হবে। (৩) বোর্দো মিকচার ০.৩% হারে তিন-চারবার স্প্রে  করতে হবে (ফুল ধরার আগে ও পরে এবং ফল সংগ্রহের আগে)। (৪) বাভিসটিন ডব্লিউ/পি ০.২ % হারে অথবা ডাইথেন-এম ০.৩ % হারে দুইবার (ফুল ধরার আগে ও পরে) স্প্রে করতে হবে।

 

*আমের বোঁটা ও ফল পচা (Stem end rot)      

 

রোগের কারণ : এ রোগ বোর্টিডিপ্লডিয়া থিয়োবোরমি (Botryodiplodia theobromae) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।

 

রোগের লক্ষণ : (১) প্রথমে বোঁটার চার দিকে কিছু জায়গা জুড়ে কালো দাগ পড়ে। (২) পরে আমের বেশির ভাগ ও সর্বশেষ অংশ পচে কালো রঙ ধারণ। (৩) আক্রান্ত স্থানে চাপ দিলে ভেতর থেকে পচা কালো গন্ধযুক্ত আমের রস বের হয়ে আসে।

 

রোগ দমন : (ক) যে কোনো একটি পদ্ধতিতে রোগ দমন করবেন (১) ডাইথেন-এম-৪৫, ০.৩% হারে দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে। (২) রিডোমিল ০.১% হারে দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে। (৩) রোভরাল ০.১% হারে দু-তিনবার স্প্রে করতে হবে। (খ) আম হারভেস্ট করার পর ৪৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৫ মিনিট ৬% বোরাক্স দ্রবণে চুবাতে হবে। (গ) ফল সংগ্রহ করার পর ডালপালা, অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে।

 

*আমের পাউডারি মিলডিউ (Powdery mildew of mango)          

 

রোগের কারণ : এ রোগ ওডিয়াম মেংগিফেরা (Oidium mangiferae) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।

 

রোগের লক্ষণ : (১) পুষ্পমঞ্জরী ও তার সংলগ্ন কচিপাতা এবং ছোট ফলের ওপর সাদা-ধূসর পাউডার দেখা যায়। (২) সাধারণত সংক্রমণ পুষ্পমঞ্জরীর অগ্রভাগে ক্ষত শুরু করে নিচের দিকে ধাবিত হয় এবং কুচকে যেয়ে ডাই-বেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। (৩) ফল অপরিপক্ব অবস্থায় ঝরে পড়ে এবং বিকৃত ও বিবর্ণ হয়।

 

দমন ব্যবস্থা : (১) আমের বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। (২) ছত্রাকের গঠন ধ্বংস করতে মাঝে মাঝে গাছে পানি স্প্রে করতে হবে। (৩) থিয়োভিট ০.৩% হারে ফুল ফোটার আগে একবার ও পরে দুবার স্প্রে করতে হবে। (৪) ম্যালাথিয়ন ০.২% হারে ফুল ফোটার পর একবার ও গুটি আসার পর ১৫ দিন পরপর দুইবার স্প্রে করতে হবে।

 

() পোকামাকড় দমন


আমের শোষক পোকা/ আমের হপার (Mango hopper) : এই পোকার তিনটি প্রজাতি ক্ষতি করে থাকে। নিম্নে ক্ষতির প্রকৃতি ও দমন ব্যবস্থা দেয়া হলো।

 

ক্ষতির প্রকৃতি : আমের অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে এ পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমের পাতা ও বোঁটায় এরা ডিম পাড়ে। এ জন্য আক্রান্ত পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং গুটি আসার আগেই ফুল ঝরে য়ায়। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ পোকার আক্রমণের অন্যতম লক্ষণ হলো, আক্রান্ত গাছের নিচে দিয়ে হাঁটলে পোকা লাফিয়ে গায়ে পড়ে।

 

দমনব্যবস্থা : এ পোকা দমন করতে হলে মুকুল আসার আগে অথবা মুকুল আসার মুহূর্ত থেকে নিম্নলিখিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে : ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লেবাসিড ৫০ ইসি চা চামচের চার চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর দু’বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ম্যালাথিয়ন বা এমএসটি ৫৭ ইসি উপরিউক্ত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।

 

*ফলের মাছি বা আমের মাছি পোকা (Mango fruit fly)


ক্ষতির প্রকৃতি : এ পোকার কিরা পাকা আমের মধ্যে প্রবেশ করে শাঁস খেয়ে ফেলে। এতে ফল পচে যায় ও ঝরে পড়ে। আক্রান্ত আম কাটলে অসংখ্য পোকা দেখা য়ায়। পোকার আক্রমণ বেশি হলে গাছের সব আম খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

 

দমনব্যবস্থা : আম পাকার আগে যখন পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ডিপটেরেক্স চা চামচের চার চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর দুইবার স্প্রে করতে হবে। অথবা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ২ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ( ওই সময়ে ফল খাওয়া যাবে না)।

 

*আমের বিছা পোকা (Mango defoliator)

 

ক্ষতির প্রকৃতি : এ পোকার কিরা আমগাছের পাতা খেয়ে ফেলে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায় এবং ফুল-ফল হয় না বা হলেও ঝরে পড়ে। তবে কোনো গাছ একবার আক্রান্ত হলে বারবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

দমনব্যবস্থা : আক্রান্ত গাছে ডাইমেক্রম ১০০ ইসি ৩০০ মিলি বা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ৪০০ মিলি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ৪৫৪ মিলি ২২৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...