এ সময়ের ফল-ফসলের রোগবালাই ও করণীয়

এ বছর কাঁঠালের মুছি এসেছে প্রচুর। কিন্তু সঠিক রোগ দমনের অভাবে কাঁঠালের ফলন ভালো হয় না। এছাড়াও কুমড়া জাতীয় সবজি, সরিষা এবং পেঁয়াজ চাষেও নানান রোগবালাই দেখা দেয়। এসব রোগের দমন এবং করণীয় নিম্নরূপঃ

 

কাঁঠালের মুচি পচা রোগে করণীয়

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান দফতরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে কাঁঠাল চাষ হয় প্রায় ১০ হাজার হেক্টরে আর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় সোয়া লাখ মেট্রিক টন। অন্য দিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে ২৬ হাজার হেক্টরে কাঁঠাল চাষ হয় আর তাতে ফলন হয় দুই লাখ ষাট হাজার মেট্রিক টন। প্রাপ্ত তথ্যদ্বয়ের মাঝে পার্থক্য থাকলেও দেশের সর্বত্র প্রতিটি বাড়িতে কয়েকটি করে কাঁঠালগাছ রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাঁঠালের রোগের মধ্যে মুছি পচা ও কাঁঠাল পচা রোগই প্রধান। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী মাসে দেশের সর্বত্র কাঁঠালে মুছি পচা রোগ দেখা দেয়। প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ ফলন নষ্ট হয় কাঁঠালের মুছি পচা রোগের কারণে।

 

রোগ : রাইজোপাস আরটোকারপি নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়। মওসুমের শুরুতে গাছে কাঁঠালের মুছিতে পচন ধরে। সাধারনত মুছির বোঁটা থেকে পচন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মুছিতে বিস্তৃত হয়। এ সময় মুছির ওপর মাকড়সার জালের মতো ছত্রাকের মাইসেলিয়াম দেখা যায়। সবশেষে মুছি পচে গাছ থেকে ঝরে পড়ে। অনেক সময় এ রোগ পূর্ণাঙ্গ কাঁঠালেও পরিনতি হয়। এতে কাঁঠালে পচন ধরে। কাঁঠাল সংগ্রহোত্তর কাঁঠাল পচা রোগের আক্রমণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। যদি কাঁঠালগাছের আশপাশে গোবর বা কম্পোস্টের স্তূপ থাকে বা ডাস্টবিন থাকে অথবা ময়লা আবর্জনার স্তূপ থাকে সে ক্ষেত্রে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। কারণ ছত্রাকের জন্য এসব জায়গা উত্তম আশ্রয়স্থল।

 

করণীয় : গাছে মুছি আসার আগে গাছের কাণ্ডের ডালপালা হালকা ছেঁটে দিতে হবে। আক্রান্ত মুছি ছিঁড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রমণ দেখা দিলে ২ গ্রাম ডাইথেন এম ৪৫ বা ০.৫ মিলি রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ ঘন্টা অন্তর দুইবার স্প্রে করতে হবে। কাঁঠালগাছের আশপাশে গোবর, কম্পোস্টের স্তূপ, ডাস্টবিন বা ময়লা আবর্জনার স্তূপ থাকলে তা অবশ্য অপসারণ করতে হবে। এতে মুছি এবং কাঁঠাল পচা রোগ দুটোই কমে যাবে।

 

কুমড়াজাতীয় ফসলের পাউডারি মিলডিওরোগে করণীয়

মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, তরমুজ, শসা, সব ধরনের কুমড়াজাতীয় ফসলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চরাঞ্চলে কুমড়া ফসলে ব্যপকভাবে এ রোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

রোগ: Erysiphe নামক এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। গাছের বয়স্ক পাতায় রোগের প্রকোপ বেশি হয়। পাতার উপরিভাগ সাদা পাউডার দিয়ে ভরে যায়। এসব পাতা পরে হলদে হয়ে যায়। মারাত্মক আক্রমণের ক্ষেত্রে গাছের পাতা শুকিয়ে যায় ও ঝরে পড়ে। গাছের সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হওয়ায় ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ফলের আকার ছোট ও বিকৃত হয়। সাধারণত রোগের জীবাণুগুলো বাতাসের মাধ্যমে উড়ে নতুন গাছকে আক্রমণ করে। দিন রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি হলে অর্থাৎ রাতের তাপমাত্রা ১০ডি. সে. এবং দিনের তাপমাত্র ২৫-৩০ডি. সেলসিয়াস হলে রোগের প্রকোপ বাড়ে।

 

করণীয় : গাছের আক্রান্ত অংশগুলো সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। পানি দিয়ে আক্রান্ত গাছ ধুয়ে দিলে রোগের প্রকোপ কমে আসে। কারণ জীবাণুগুলো জীবিত গাছ ছাড়া বাঁচতে পারে না। পানি দিয়ে আক্রান্ত গাছ ধুয়ে দিলে জীবাণুগুলো মাটিতে পড়ে মারা যায়। সালফার-জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে এ রোগকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সালফোটক্স ৮০ ডব্লিউপি ০.৪ শতাংশ হারে (১০ লিটার পানিতে ৪০ গ্রাম সালফোটক্স মিশিয়ে) অথবা থিওভিট ৮০ ডব্লিউপি ০.২ শতাংশ হারে অথবা ম্যাকসালফার ৮০ ডব্লিউপি ০.২ শতাংশ হারে রোগ দেখা দেয়ার পর ৭-১০ দিন অন্তর দুইবার স্প্রে করতে হবে। সাধারণত ফসল মওসুমে এক থেকে দুইবার ওপরের ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে রোগের আক্রমণ হয় না।

 

পেঁয়াজের ব্লচ রোগে করণীয়

এ রোগটি বাংলাদেশে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে বিবেচিত। পেঁয়াজে দুই ধরনের ব্লচ রোগ দেখা যায়। একটি হলো পার্পল ব্লচ অন্যটি হোয়াইট ব্লচ। কখনো কখনো দু’টি রোগ একই সাথে থাকতে পারে। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে রোগটি দমনে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হয়।

 

রোগ: Alternaria porri নামক ছত্রাকের আক্রমণে পার্পল ব্লচ এবং Stemphylium নামক ছত্রাকের আক্রমণে হোয়াইট ব্লচ রোগ হয়। রোগটি পেঁয়াজের পাতা ও পুষ্পদণ্ডে দেখা দেয়। আক্রান্ত অংশে প্রথমে ক্ষুদ্র পানিভেজা বাদামি দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগটি বাড়তে থাকে। পূর্ণাঙ্গ দাগে কয়েকটি চক্র পরিলতি হয়। পার্পল ব্লচ রোগের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ দাগটি রক্তাভ বা বেগুনি রঙ ধারণ করে আর হোয়াইট ব্লচের ক্ষেত্রে দাগটি সাদা বর্ণের হয়। কখনো কখনো দুটি রোগই একসাথে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথমে হোয়াইট ব্লচ এবং পরে রক্তাভ ব্লচ দেখা দেয়। পেঁয়াজের পাতার ক্ষেত্রে পাতার শীর্ষ থেকে আক্রমণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে নিচের দিকে আক্রমণ বিস্তৃত হয় এবং সম্পূর্ণ পাতা শুকিয়ে যায়। পুষ্পদণ্ডের যেকোনো জায়গায়ই আক্রমণ হতে পারে। আক্রান্ত পুষ্পদণ্ড ভেঙে যায়। ফলে বীজ অপুষ্ট থাকে।

 

করণীয়: আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগটি বীজবাহিত বিধায় রোভরাল বা প্রোভেক্স ২০০ দ্বারা ০.৩ শতাংশ হারে বীজ শোধন করে লাগাতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল এবং ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বীজ উৎপাদনের জন্য পেঁয়াজ চাষ করলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে পুষ্পদণ্ড আসার পর প্রতি সপ্তাহে একবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

 

সরিষার পাতা ঝলসানো রোগে করণীয়

সরিষা বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। লাভজনক বিধায় দিন দিন বাংলাদেশে সরিষা চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। চলতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরিষাগাছের পাতায় দাগ ও ঝলসানো রোগ লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণত আগাম চাষে রোগের আক্রমণ কম হয়।

 

রোগ: Alternaria brassicae নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগটি হয়। গাছের নিচের বয়ষ্ক পাতায় এ রোগটি প্রথম দেখা দেয়। পাতায় কালচে রঙের দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে দাগ বড় হতে থাকে। পূর্ণাঙ্গ দাগে কয়েকটি চক্র পরিলতি হয়। অনেক দাগ একত্র হয়ে সম্পূর্ণ পাতাকে ঝলসে দেয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে রোগটি দ্রুত গাছের কাণ্ড, পত্রবৃন্ত ও ফলের বোটায় ছড়িয়ে পড়ে।

 

করণীয়: আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগটি বীজবাহিত বিধায় রোভরাল বা প্রোভেক্স ২০০ দ্বারা ০.৩ শতাংশ হারে বীজ শোধন করে লাগাতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পাণিতে ২ গ্রাম রোভরাল এবং ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও ডানথেন এম ৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে স্প্রে করা যেতে পারে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...