পেঁপে - সব চারাতেই ফল ধরবে

রোপণ করা সব চারাতেই ফল ধরবে। সুস্বাদু ফল ও সবজি পেঁপের এমন জাতীয় জাত উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। গাজীপুরের সালনায় অবস্থিত কৃষি গবেষণায় ও উচ্চশিক্ষায় বিশেষায়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস ও প্ল্যান ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক এমএ খালেকমিয়া টানা ৪ বছর গবেষণা চালিয়ে এই সাফল্য অর্জন করেছেন।

 

গবেষণার তথ্যমতে, বিশ্বের কয়েকটি দেশে এ বিষয়ক গবেষণায় সাফল্য অর্জিত হলেও দেশে এধরনের সফলতা এটাই প্রথম। পেঁপের ৩২ লিঙ্গের গাছ থাকলেও পুরুষ, স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছই আমাদের নজরে আসে। এদের মধ্যে শুধু স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের পেঁপের গাছে ফল দিয়ে থাকে।

 

বাণিজ্যিকভাবে চাষের ক্ষেত্রে পরপরাগায়িত বীজ ব্যবহার করা হয়। এ বীজ থেকে ৫০ ভাগপুরুষ গাছ জন্মায়, যাতে কোন ফল পাওয়া যায় না। পেঁপে চাষীরা এক্ষেত্রে ৩/৪টি চারা একত্রে রোপণ করে থাকেন। ফুল আসার পর পুরুষ গাছ কেটে রাখা হয় শুধু স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছ। এ প্রক্রিয়ায় ফল পেতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়, একই সঙ্গে প্রচুর ভূমি অপচয় হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৭১ হাজার ৯শ’ ৭৭ টনপেঁপে উৎপাদিত হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ৭ টনের মত।

 

গবেষক অধ্যাপক ড. এম এ খালেক মিয়া সম্প্রতি বাংলা নিউজের কাছে তুলে ধরেন তার গবেষণার বিভিন্ন দিক। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে পেঁপের নির্দিষ্ট কোন জাত নেই। ৩২টি লিঙ্গে পেঁপের গাছ নজরে এলেও পুরুষ, স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছই দৃশ্যমান হয়। এদের মধ্যে কেবল স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছ ফল দিয়ে থাকে। লিঙ্গ সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় তাই প্রয়োজনের তিনগুণ চারা রোপণ করতে হয়। গাছ বড় হওয়ার পর স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছ রেখে পুরুষ গাছ কেটে ফেলতে হয়। এতেঅনেক ভূমি অপচয় হয়। পুরুষ গাছ মাটির পুষ্টি ও সার গ্রহণ করায় অন্য গাছেও সেই ঘাটতিপড়ে। এতে ফলন অনেক কম হয় এবং উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়।’’

 

গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এমএ খালেক মিয়া বলেন, ‘‘দেশের ক্রমাগত কৃষিভূমি হ্রাস ওজন সংখ্যার বৃদ্ধিতে ফল ও সবজি চাহিদা পূরণের বিষয়টি বিবেচনায় এনে ২০০৮ সালে পেঁপে গবেষণা শুরু করি। পুরুষ, স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের চারা রোপণ করে সেখান থেকে জেনেটিক্যাললিপিওরিফাই আরম্ভ করি। সেক্স মেন্যুপুলেট (লিঙ্গান্তর) করে কেবল স্ত্রী ও উভয় লিঙ্গের গাছরেখে পুরুষ গাছ বাদ দেওয়া হয়। বাছাই প্রক্রিয়ায় এ দুই প্রকারের পেঁপে গাছে শতভাগ ফলধরে।’’

 

বহির্বিশ্বে পেঁপে নিয়ে গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘চায়না, অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানেএ ধরনের গবেষণা হয়েছে এবং সেই গবেষণার ফল কাজে লাগিয়ে চাষাবাদও হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে এই পেঁপে নিয়ে এ ধরনের গবেষণায় সাফল্য এটাই প্রথম। রেড লেডি নামের বিদেশের ওই পেঁপের জাতের ১ কেজি বীজের দাম প্রায় লাখ টাকা।’’

 

বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ ও গবেষণালব্ধ জাত সম্প্রসারণের প্রসঙ্গে এমএ খালেক মিয়া বলেন, ‘‘বাছাইকৃত পেঁপের এ জাত থেকে বছরে উৎপাদন কমপক্ষে হেক্টরে ৭৫ হাজার কেজি । উদ্ভাবিত পেঁপের এই নতুন জাত বাণিজ্যিক ভাবে চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে যে পরিমাণ পেঁপে ধরেছে, স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে আরো অধিক পরিমাণ ভাল মানের বেশিফল পাওয়া সম্ভব। আমরা এখন গবেষণা ফল নিয়ে ফিল্ডে যাবো।’’

 

অধ্যাপক এমএ খালেকের সঙ্গে এ গবেষণায় সহযোগী গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসরীন আকতার আইভী । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ‍বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাঙ্গন কার্যক্রমের পরিচালক ‍ওবায়ো টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ তোফাজ্জাল ইসলাম গবেষণা ফলাফল সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে বাংলা নিউজকে বলেন, ‘‘বাছাইকৃত এই জাতটি দেশের পেঁপে উৎপাদনে বড় ধরনের সাফল্য নিয়ে আসতে সক্ষম। কারণ, এতে ফলন দশগুণ বেড়ে যাবে। ফলে পেঁপে উৎপাদন অন্যান্য ফসলের চাইতে লাভজনক হবে। এটি যেহেতু হাইব্রিড জাত নয় তাই সহজে এর বীজ উৎপাদনকরা যাবে। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে সঠিকভাবে এ জাত সম্প্রসারণ করা গেলে তা দেশের সবজিও ফলের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাঙ্গন কার্যক্রম প্রযুক্তিটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। ’’ তিনি বলেন, ‘‘দু’ভাবে এটি সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। প্রথমত: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সীড সার্টিফিকেশন এজেন্সিতে নিবন্ধন করা। দ্বিতীয়ত: কোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। তবে আমরা দ্রুত ও সুলভে কৃষকদের মাঝে এই জাত সম্প্রসারণে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়টিও চিন্তা করছি।’’ অধ্যাপক তোফাজ্জল বলেন, ‘‘সোসাইটির সমস্যা চিন্তা করে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ওলাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাঙ্গন কার্যক্রমের লক্ষ্য। উত্তর আমেরিকার আদলে বহিরাঙ্গন কার্যক্রম বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রধান ম্যান্ডেটের (শিক্ষা, গবেষণা ও বহিরাঙ্গন) অন্যতম একটি যা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত।

 

কৃষি বিজ্ঞানী খালেক মিয়ার জীবনী সংক্ষেপ কৃষি বিজ্ঞানী এম এ খালেক মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫১ সালের ১ জুন টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার এলেঙ্গা ইউনিয়নের খোকসা বাড়ি গ্রামে। ১৯৭২ সালে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায় থেকে জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান ব্রিডিং বিষয়ে এমএসসি সম্পন্ন করে ১৯৮৫ সালে ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। অধ্যাপক খালেক ১৯৯১ সালে জাপানের কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিষয়ে পোস্টডক্টরাল ও আমেরিকার অরিগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে একাডেমিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে ১৯৯৩ সালে ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন পাবনার ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে। ১৯৭৯ সালে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী‍ অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৯১ সাল থেকে অধ্যাবধি কর্মরত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস ওপ্ল্যান ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে। আন্তর্জাতিক জার্নালে ১৮টি ও দেশিয় জার্নালে ৮৬টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার। বিভিন্ন শস্যের জাত ও উচ্চফলনশীল জাত উন্নয়নে কাজ করে চলছেন এই কৃতি কৃষি বিজ্ঞানী। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর এই কৃষি বিজ্ঞানী ১ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...