ঘেরে মাছ শাকসবজি ও ধান চাষ

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি সারাবছর উৎপাদনশীল রাখতে হবে। একই সাথে একই জমি থেকে একাধিক ফসল উৎপাদন করা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঘেরে একই সাথে একই জমি থেকে একই সময়ে ধান, মাছ ও সবজি চাষ করে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি সবসময় উৎপাদনশীল রেখে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। একই জমিতে শুধু ধান চাষ করে লাভবান হওয়া যায় না বলে সারাদেশের নিচু জমিতে ঘের তৈরি করে একই সাথে ধান, মাছ, চিংড়ি ও সবজি চাষ করে সবাই লাভবান হতে পারেন। 

 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশ বা ১ বিঘা আয়তনের জমিতে শুধু ধান চাষ করে আয় হয় ২ হাজার ২০০ টাকা। সমন্বিত ঘেরে ধান, মাছ, চিংড়ি ও শাকসবজি চাষ করে ১৯ হাজার টাকা আয় হয়, যা শুধু ধানের প্রায় ৯ গুণ বেশি। অন্যান্য সুবিধা হচ্ছেন্ধ সারাবছর পর্যায়ক্রমে পুষ্টিসহ আয়মূলক পেশায় থেকে আত্মকর্মসংস্খানের ব্যবস্খা হয়। বিনিয়োগকৃত অর্থে ঝুঁকি কম।

 

ঘের তৈরিনিচু জমি বা ধান ক্ষেতের ভেতর নালা বা গর্ত কেটে জমির চার দিকে বাঁধ দিয়ে ধান, মাছ ও শাকসবজি চাষের উপযোগী করা হয়। পাঁচ থেকে আট মাস পানি থাকে এমন জমি উপযোগী। ২০ থেকে ৫০ শতাংশ জমিতে ঘের তৈরি করলে সঠিকভাবে ব্যবস্খাপনা করা যায়। বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতার চেয়ে ঘেরের বাঁধের উচ্চতা অন্তত আধা মিটার উঁচু, বাঁধের ওপর রাস্তা এক-দুই মিটার চওড়া এবং বাঁধের ঢাল ১:১ হতে হবে। বাঁধের মাটি যথেষ্ট এঁটেল না হলে ঢাল ১:১.৫ বা ১:২ করা যেতে পারে। এতে বাঁধ টেকসই হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হবে। বাঁধের ওপর চলাচল এবং শাকসবজির চাষ করা যায়। বাঁধের ভেতরের দিকে এক মিটার চওড়া একটা বকচর বা বার্ম রাখবেন, জাল টানা, খাদ্য দেয়া, চিংড়ির আচরণ পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি কাজ করা সহজ হবে। ঘেরের ভেতর চার দিকে তিন মিটার চওড়া, এক মিটার গভীরতা ও ১:১.৫ ঢালবিশিষ্ট খাল তৈরি করতে হয়। খাল বকচরের ধার ঘেঁষে হলে চিংড়ির খাবার খালের মধ্যে গিয়ে পড়বে। খাল চিংড়ির নার্সারি এবং মাছ বড় করার জন্য উপযোগী। চওড়া ও অগভীর খালে পানির সঞ্চালন থাকে বলে অক্সিজেনের অভাব হয় না। ঘেরের গভীরতা ১ থেকে ১.৫ মিটার হতে হবে। পানির গভীরতা কম হলে পানি সহজে গরম হয়, অক্সিজেনের অভাব হয় এবং ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। ঘের দেড় মিটারের বেশি হলে চিংড়ির খাদ্য তৈরি হয় না বরং বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। ঘেরের মূল জমির বাঁধ ও নালা হবে ২৫ ভাগ এবং চাতাল বা ধান ক্ষেত হবে ৭৫ ভাগ।

 

ঘেরে পানি সরবরাহবেশির ভাগ ঘের বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টির পানি পর্যাপ্ত না হলে অগভীর নলকূপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা যেতে পারে। নালা বা খালে তিন ফুটের মতো পানি থাকতে হবে। তবে প্রায় সারা বছর পানি থাকলে মাছ চাষ ভালো হয়।

 

ধান চাষধান রোপণের সময় ধানক্ষেতে এক-দুই ইঞ্চি পানি থাকা প্রয়োজন। স্খানীয় বা উচ্চফলনশীল জাতের ধান ঘেরে চাষ করা যায়। শক্ত কাণ্ডবিশিষ্ট ধানের জাত ঘেরের জন্য উপযোগী। প্রতি ছয়-সাত সারি অন্তর একটি সারি ফাঁকা স্থান রাখতে হবে। ফাঁকা দিয়ে চিংড়ি ও মাছ সহজেই নালা বা খালে চলাচল করতে পারে। অন্যান্য পরিচর্যা ও পদ্ধতি সাধারণ ধান চাষের মতো।

 

ঘেরের আইলে সবজি চাষঘেরের আইলে করল্লা, লাউ, শিম, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পুঁইশাক, কলমিশাক, পালংশাক, ডাঁটা, চিচিঙ্গা, শসা, বরবটি ইত্যাদি চাষ করা যায়। এসব সবজির মাচায় জৈবসার, ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার দিতে হয়। মাচায় বা ভূমিতে সবজি চাষ করা যায়। ঘেরে সবজি চাষ করলে ভূমিক্ষয় রোধ হয়, ঘেরে বাঁধ ভাঙে না এবং পানি ঘোলা হয় না। অর্থাৎ শাকসবজিও পাওয়া যায় এবং মাছ চাষের জন্য উপকার হয়।

 

চিংড়ি মাছ চাষখাল বা নালাতে গলদা চিংড়ি, রুই, কাতলা, সিলভার কার্প, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, মৃগেল, গনিয়া ইত্যাদি মাছ চাষ করা যায়। গলদা পোনা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করে কিংবা পকেট ঘরে লালন পালন করে ঘেরে ছাড়া যায়। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) ঘেরে চিংড়ি পোনা ছাড়তে হবে ১ হাজার ৩২০টি এবং কার্পজাতীয় মাছের পোনা ছাড়তে হবে ৩৩০টি। পকেটে ঘেরের তলদেশের কাদা ছয় ইঞ্চির বেশি হলে তুলে ফেলতে হবে। 

 

চিংড়ি খোলস বদলানোর সময় দুর্বল থাকে। এ সময় নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্খা নিতে হবে। অন্যথায় সবল পোনা দুর্বল পোনাকে খেয়ে ফেলে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পানিতে নারিকেলের ডাল, তালপাতা, গোলপাতা, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্য পানিতে প্রতি শতাংশে এক কেজি চুন, তিন থেকে পাঁচ কেজি জৈব সার। ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্যে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ আমিষ, গমের ভুসি, মিহিচালের কুঁড়া ও সরিষার খৈল সমপরিমাণে মেশাতে হবে।

 

প্রতি মাসে ঘেরের ২৫ থেকে ৫০ ভাগ পুরনো পানি পরিবর্তন করে নদী বা নলকূপের পানি দিলে চিংড়ি ও মাছের স্বাস্খ্য ভালো থাকে। ঘেরের পরিবেশে ভালো রাখলে চিংড়ির রোগবালাই হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। প্রতিবার পোনা মজুদের আগে রাক্ষুসে মাছ দমন, নিষ্কাশন, তলদেশের মাটি রোদে শুকানো, চুন ও সার প্রয়োগ করা ও পাড় মেরামত করা।

 

প্রতিদিন একবার বিশেষ করে সকালে ঘেরের চার পাশে ঘুরে দেখতে হবে যে, চিংড়ি বা মাছের কোনো অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়ে কি-না। দিনের বেলা চিংড়িকে ঘেরের পাড় ঘেঁষে সাঁতার কাটতে অথবা পানির মধ্যে লাফালাফি করতে দেখলে ঘেরের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পানি পরিবর্তন করতে হবে। পানি পরিবর্তন সম্ভব না হলে ঢেউয়ের সৃষ্টি করতে হবে। খাদ্য ও সার দেয়া সাময়িক বাঁধ রাখতে হবে।

 

মাছ আহরণছয় মাসে প্রতিটি চিংড়ির ওজন গড়ে ১০০ গ্রাম এবং কার্পজাতীয় মাছের ওজন গড়ে ৫০০ গ্রাম হয়। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় গলদা চিংড়ি খোলস পাল্টায়। তাই এ সময় চিংড়ি আহরণ করা ঠিক নয়। বর্তমানে এই ঘের পদ্ধতিতে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে মাছ, চিংড়ি, ধান ও শাকসবজির সমন্বিত চাষ হলেও সারাদেশে এর চাষ বিস্তার করা প্রয়োজন। দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে এই ঘেরে সমন্বিত চাষ পদ্ধতি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...