চাষাবাদ - দোতলা পদ্ধতিতে

সোলার প্যানেল বসিয়ে একসঙ্গে ধান সবজি চাষ সম্ভব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি নষ্ট না করে এ পদ্ধতিতে দ্বিগুণ ফসল উৎপাদন করা যাবে

দোতলা পদ্ধতিতে কৃষিকাজ বর্তমানে দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে ফসল উৎপাদনের তেমন কোন হেরফের হচ্ছে না, বরং দ্বিগুণ উৎপাদনের কারণে কৃষক লাভবান হচ্ছে। আর এ পদ্ধতিতে সোলার প্যানেল বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করলে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এ পদ্ধতিতে কৃষিজমি নষ্ট হয় না। ফসলের ক্ষেতে ছায়া পড়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। সারাদিন রোদ ও বাতাস থাকলে মাচার নিচের ফসলের গায়েও তা লাগবে। ইতোমধ্যে গ্রামীণ শক্তি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে আসছে। আর তাই এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সোলার প্যানেল বসিয়ে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধান উৎপাদনের চিন্তা করছে সরকার।

 

বর্তমানে সোলার পাম্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কৃষিজমিতে সোলার প্যানেল বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাতে অনেক জমি নষ্ট হচ্ছে। ফলে সে জমিতে অতিরিক্ত কোন ফসলের চাষ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, ধান ক্ষেতের ওপরে মাচা তৈরি করে দোতলা পদ্ধতিতে সহজেই লাউ কুমড়োর চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে মাচার নিচের ফসলের উৎপাদনের কোন হেরফের হচ্ছে না, বরং দ্বিগুণ ফসল উৎপাদন হচ্ছে। মাচার ফাঁক গলে যে আলোÑ বাতাস আসে তা দিয়ে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

 

এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সোলার প্যানেল বসিয়ে কৃষিজমিতে সেচের কথা জানিয়েছেন বিদ্যুত সচিব আবুল কালাম আজাদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে প্যানেল বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করলে অতিরিক্ত কৃষিজমি নষ্ট না করেই ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে। বিদ্যুত সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ পদ্ধতিতে প্যানেল বসিয়ে প্যানেলের নিচে ফসল উৎপাদন করা যায় কি না তা গবেষণা করে বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হবে। এতে করে সেচের জমিতে প্যানেল বসালে যে জমি নষ্ট হয় তা অন্য কাজে বা ফসল উৎপাদনেরও ব্যবহার করা যাবে। জমি নষ্ট না করে কৃষিজমিতে প্যানেল বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হলে তাতে ফসলের উৎপাদনও অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

 

দেশে দোতলা পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের এ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলছেন বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর গবেষকরা। তাঁরা দেখিয়েছেন ধানের ক্ষেতে মাচা করে লাউ-কুমড়োর চাষ করা হলে তাতে নিচের ধান ক্ষেতে উৎপাদনে কোন সমস্যা নেই। গবেষণায় তাঁরা দেখিয়েছেন একটি ফাঁকা জমিতে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন করা হচ্ছে, দোতলা পদ্ধতির চাষের ক্ষেত্রেও একই ধরনের উৎপাদন হচ্ছে, বরং দোতলা পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে কৃষক অধিক লাভবান হচ্ছে। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর মহাপরিচালক এমএ মতিন জানান, এ পদ্ধতিতে কৃষক ধান ক্ষেতের ওপরে লাউ-কুমড়োর চাষ করে অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকার ফসল উৎপাদন করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে যদি ফসলের উৎপাদন না কমে তাহলে একইভাবে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দেশে সৌরবিদ্যুত নিয়ে কাজ করছে গ্রামীণ শক্তি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবহার জনপ্রিয় করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামে যেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি সেসব এলাকায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় তারা বিদ্যুত পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি সোলার হোম সিস্টেম ছাড়াও কৃষিজমিতে সোলার পাম্প বসিয়ে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সহায়তা দিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে সেচপাম্প। প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে নওগাঁর সাপাহার এলাকায় একই পদ্ধতিতে সোলার প্যানেল বসিয়ে তারা সবজি উৎপাদন ও ধান উৎপাদনে সহায়তা দিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প বিদ্যুত ব্যবহার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এমএ গোফরান। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে ফসলের জমি নষ্ট না করেই উৎপাদন করা সম্ভব। দিনে রোদ থাকলে নিচের ফসলে ছায়া পড়ার সম্ভাবনা নেই। যেভাবেই হোক ফসলের গায়ে রোদ লাগবে। এতে করে ফসল উৎপাদনের তেমন কোন হেরফের হবে না। তিনি বলেন, গ্রামীণ শক্তি ইতোমধ্যে এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ধান ও সবজি একসঙ্গে উৎপাদন করছে।

 

এখন আর সোলার প্যানেলের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ আলোকিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, কৃষি উৎপাদনে এখন সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। ইডকলের উদ্যোগের দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে সোলার সেচপাম্প। এর মধ্যে নওগাঁর সাপাহারে স্থাপন করা হয়েছে ১১.২ কিলোওয়াটের একটি সেচপাম্প, যা থেকে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটার পানি সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে। ইডকলের আর একটি সেচপাম্প স্থাপন করা হচ্ছে যশোরের বানিয়ালিতে। এর মাধ্যমে সাড়ে ২২ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। ইডকলের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, এসব সেচপাম্প প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেচ বাবদ খরচ হওয়া বছরে ৮ হাজার লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌরবিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কারণ এখানে বছরে তিন শ’দিনেরও বেশি রোদ থাকে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভিত্তিতে সৌরবিদ্যুত নিয়ে কাজ করছে। ইনস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইডকল) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সেক্টরে বিশ্বব্যাংক সামগ্রিক অর্থায়ন করছে। সরকারী মালিকানার এই প্রতিষ্ঠান সারাদেশে সৌরবিদ্যুত প্রসারের জন্য অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ১৫ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখের বেশি বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। ফলে গ্রামীণ জনপদে প্রায় এক কোটি লোক এখন সৌরবিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা হলে উৎপাদন দ্বিগুণ হতে পারে।

 

তবে দেশে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা বাড়লেও এর দাম এখনও মানুষের নাগালের বাইরে। গত কয়েক বছরে কিছুটা কমলেও এখনও তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। ডাউন পেমেন্ট বা কিস্তি সুবিধার মাধ্যমে সৌরবিদ্যুত ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সোলার প্যানেলের সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। এখন বিভিন্ন কাজে এটিকে ব্যবহারের চিন্তভাবনা চলছে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...