পানিফল - জলাবদ্ধ এলাকার ফসল
জলাবদ্ধ এলাকার ফসল পানিফল - দারিদ্র

বর্ষা মৌসুমে নিচু এলাকাগুলো যখন পানিতে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে, তখন কিছুই করার থাকে না কৃষকদের। তিন চার মাসে না যায় সেখানে মাছ চাষ করা না যায় ভাসমান কৃষি কাজ করা। কোনো কোনো এলাকায় কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে বদ্ধ জলাশয়ে পানিফল চাষ করতে পারলেও বেশিরভাগ এলাকার কৃষিজীবীর কাছেই জলাবদ্ধতা মোকাবিলা করে টিকে থাকাই কঠিন কাজ। ঠিক এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচাতে পেরেছেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের জলাবদ্ধ এলাকার প্রান্তিক কৃষিজীবীরা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তারা জলাবদ্ধ শত শত একর জমিতে আবাদ করছেন পানিফল।

 

স্বাধীনতার আগে সিদ্দিক নামের এক অবাঙালি জামালপুরের জলাভূমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছিলেন পানিফল। তারপর দিনে দিনে সম্প্রসারিত হয়েছে এর চাষ। তখন জনসংখ্যা কম ছিল, ছিল না আজকের মত এত বেশি নদী ভাঙন, এমনকি জলাবদ্ধ ভূমিও ছিল না এত বেশি বিস্তৃত। তখন পানিফলের চাষ হয়েছে শখের বশে। কে জানতো, এই পানিফলই জামালপুর এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার বড় একটি অবলম্বন হবে একদিন।

 

জামালপুর। এক দুর্ভাগা জনপদ। বলা যায় সুবিধাবঞ্চিত এক দুর্গম এলাকা। দিনের পর দিন এখানে নদীভাঙা মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। এক সময় যাদের জোত-জমি-যশ সবই ছিল, আজ তাদের অনেকেই নিঃস্ব। বাঁধের ওপর গুচ্ছগ্রাম নামের আশ্রয়প্রকল্পে কোনোরকমে মাথা গুঁজে,পানি ফল কুড়িয়ে, অথবা কোনোমতে চাষ করে এক মৌসুমে দিন গুজরান করছেন।

 

বাংলাদেশে ফলটিকে পানিফল বা শিংড়া বললেও বৈজ্ঞানিক নাম ফলটি পরিবারের বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। লতার মত গাছটি ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পানির নিচে মাটিতে এর শেকড় থাকলেও পানির উপরে ভেসে থাকে পাতাগুলো। ফলগুলোতে শিং -এর মত কাঁটা থাকে বলে এর নামকরণ হয়েছে শিংড়া। আবার কারো মতে সিঙ্গাড়ার মত দেখতে বলে এর নাম হয়েছে শিংড়া। কচি অবস্থায় পানিফল বা শিংড়া দেখতে প্রথমে লাল; একটু পরিপুষ্ট হলে সবুজ এবং সব শেষে কালো রঙ ধারণ করে। ফলটির খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের মিষ্টি শাঁসটি খেতে বেশ সুস্বাদু।

 

পানিফল ১২ বছর পর্যন্ত অংকুরোদগম সক্ষম থাকে। অবশ্য ২ বছরের মধ্যে অংকুরোদগম হয়ে যায়। তবে বীজ তৈরি ও সংগ্রহের জন্য রয়েছে বিশেষ পদ্ধতি। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ৩০০০ বছর আগে চীনে পানিফলের চাষ হত। সেই হিসেবে পানিফলকে একটি প্রাচীন ফল বলা যেতে পারে।

 

প্রতি বছর ভাদ্র মাস থেকে পানি ফল রোপণ শুরু হয়ে চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। আর অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাসের শেষ পর্যন্ত চলে পানি থেকে ফল তোলার কাজ। তবে পানি থেকে ফল সংগ্রহের সময় পানির ভেতর ভেসে থাকার জন্য স্থানীয়ভাবে ব্যবহার হয় একটি বিশেষ টেকসই প্রযুক্তি।

 

যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কৃষকরা প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। জলাবদ্ধতার কারণে কোনো ফসলই সেখানে চাষ করা সম্ভব হয় না। বিকল্প ফসল হিসেবে পানিফলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে এলাকার অসংখ্য পরিবার। চাষিরা বলেছেন, ইতোমধ্যে পানি ফলের চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহুমুখী কৃষিবাণিজ্যের বলয়। এর চারাও বিক্রি হচ্ছে একেকটি ২ থেকে ৩ টাকা করে। পানিফল লাভজনক, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই ফলের চাষের পেছনেও ব্যয় বাড়ছে দিনের পর দিন। আর ব্যয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে কীটনাশকের পেছনে। আর এর মধ্য দিয়েই পানিতে বিস্তার ঘটছে বিষের। চিন্তিত এ নিয়ে এলাকার সচেতন মহল। আবার এর উপকারী দিকও রয়েছে। কৃষক সোনা মিয়া বলেছেন, পানিফলের জমিতে বোরোর আবাদ ভাল হয়। কারণ, পানি ফল উঠে যাওয়ার পর লতাপাতা, গাছ ও ফল পচে মাটিতে মিশে উত্কৃষ্টমানের জৈবসার হয়। আর এর ফলে জমিতে সার কম লাগে এবং ভাল ফলন পাওয়া যায়।

 

সবচেয়ে বড় কথা জলাবদ্ধ পতিত জায়গায় আর পতিত থাকছে না। পানিফলের চাষ হচ্ছে। আর সেই পানিফল এনে দিচ্ছে কৃষক পরিবারের হাসি। তবে কোনো কোনো কৃষক বলেছেন বর্তমানে তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে অধিক কীটনাশক প্রয়োগের কারণে। অথচ প্রতি কেজি পানিফল বিক্রি হচ্ছে ১০/১২ টাকায়। দামটা যদি একটু বেশি হত তাহলে পানিফল চাষে আরো বেশি উত্সাহী হত কৃষকরা।

 

পানিফল বা শিংড়া নদীভাঙা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য শুধু আয়েরই পথ নয়, বরং প্রতিদিনের এক দু’বেলার খাদ্য চাহিদা পূরণেরও ভূমিকা রাখছে। দরিদ্র পরিবারগুলো ভাতের বদলে খাচ্ছে পানিফল। মানুষের এই নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাসকে গুরুত্ব দিয়েই দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে পানিফলের বাজার। এখন সারাদেশের বাজারেই সবজির দোকানগুলোতে স্থান করে নিয়েছে পানিফল। কাঁচা অথবা সেদ্ধ পানিফল বিক্রি করে তিনচার মাস সংসার চালান অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। অনেকে এখান থেকে পাইকারি হিসেবে পানিফল কিনে পাঠান রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে।

 

পানিফল স্থানীয়ভাবে যা শিংড়া বা সিঙ্গাড়া ফল নামে পরিচিত। শুধু জামালপুরই নয়,সাতক্ষীরা,দিনাজপুর, গাইবান্ধা,যশোরসহ অনেক জেলাতেই জলাবদ্ধ জায়গায় চাষ হচ্ছে পানিফল। আর এর ফলে প্রান্তির চাষি পরিবারে মুখে ফুটে উঠছে হাসি।

 

চিন্তার ভাঁজও আছে কৃষকের কপালে। একজন কৃষক বলেছেন, আগে বিলের আয়তন অনেক বেশি ছিল। জলাভূমিতে পানিফলও খুব ভাল হত। কিন্তু বর্ষায় নদীর বালি ঢুকার কারণে পানিফলের চাষ সব জায়গায় ভাল হচ্ছে না। অনেক এলাকায় চাষ বন্ধও হয়ে যাচ্ছে।

 

শত প্রতিকূলতায় টিকে থাকার শক্তি ও সাহস দুইই আছে কৃষক তথা গ্রামীণ জনগোষ্ঠির। দেওয়ানগঞ্জের জলাবদ্ধ এলাকায় পানিফলের চাষ করে তার প্রমাণ রেখেছেন এলাকার শত শত কৃষক। দেশের অনেক এলাকা আছে যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময় জলাবদ্ধ থাকে। যেমন দক্ষিণাঞ্চলের ভবদহ বিল ও কুমিল্লার মনোহরদি। এরকম আরো অনেক স্থানেই অনায়াসেই চাষ করা যেতে পারে পানিফলের। এতে একদিকে প্রান্তিক কৃষকরা যেমন আর্থসামাজিক উন্নয়নের সুযোগ পাবেন, অপরদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্য তালিকায় যুক্ত হবে নতুন আরেকটি ফল।

 

 



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...