খেজুর - সৌদি খেজুরে অপার আয়
খেজুরগাছে কীটনাশক ছিটানোর কাজ তদারকি করছেন ময়মনসিংহের ভালুকার মোতালেব হোসেন

ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের প্রতি ঝোঁক ছিল মোতালেব হোসেনের। পড়ায় মন বসত না। অষ্টম শ্রেণীর গণ্ডি পেরিয়েছেন কোনোমতে। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ দেখাশোনা করে কাটে দিন। বয়স বাড়ে। যখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময়, তখন বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুকুরে আফ্রিকান মাগুরের চাষ করেন। সময়টা ছিল ১৯৯৬।

আফ্রিকান মাগুরের চাষ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন তখন। সঠিক পদ্ধতি জানা না থাকায় মাছ চাষে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হয় তাঁকে। এবার বিদেশে পাড়ি জমানোর চিন্তা আসে মাথায়। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ফের বাবার কাছে হাত পাতেন। সেখানেও প্রায় লাখ খানেক টাকা মার খান।


মাছ চাষে লোকসান, বিদেশে যাওয়ার টাকা দিয়ে মার খাওয়া। লজ্জায় বাড়ি ছাড়েন তিনি। অবশ্য পরে বিদেশ যাওয়ার শখ পূরণ হয় তাঁর। শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয় ১৯৯৮ সালে তাঁকে সৌদি আরব পাঠান। শুরু হয় নতুন গল্প।


দেশের মাটিতে খেজুর বাগানের চিন্তা: সৌদি আরবে গিয়ে প্রথমে আলুখেতে কাজ শুরু করেন। ছয় মাস পর একই মালিকের খেজুর বাগানে কাজ করার সুযোগ আসে। সারা দিন কাজ করার পাশাপাশি মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়। সৌদি-খেজুর বাংলাদেশের মাটিতে চাষ করা সম্ভব কি না! সুযোগ পেলেই মোতালেব বাগানের মালিককে প্রশ্নটা করতেন। কিন্তু মালিক তাঁকে নিরাশ করতেন। শেষে গোপনে বাগানের একপাশে ১০টি খেজুরের চারা লাগান। চারাগুলোতে রোজ পানি দিতেন। চিন্তা ছিল, বাংলাদেশে তো বৃষ্টি হয়। তাই পরীক্ষা করে দেখা, পানি দিলে চারা টিকে কি না। বছর ঘুরল। ১০টি চারা থেকে তিনটি টিকল, ফলনও ধরল। এর পর থেকেই মাথায় ভূত চাপে দেশে গিয়ে সৌদি খেজুরের চাষ করার ।


‘পাগলামির’ শুরু: '৩৫ কেজি খেজুর ছাড়া কিছুই সঙ্গে আনতে পারিনি।’ নিজের খেজুর বাগানে বসে এক যুগ আগের স্মৃতিমন্থন করছিলেন মোতালেব। খেজুর বাগান করার নেশায় ২০০১ সালে দেশে ফিরেন। বিদেশ থেকে ফেরার খবরে আত্মীয়-পড়শিরা দেখতে এলে মোতালেব সবাইকে খেজুর খেতে দেন। খেজুর খেয়ে কেউ মুখ থেকে বিচি ফেলামাত্রই মোতালেব তা কুড়িয়ে সংরক্ষণ করতে লাগলেন। সবাই একে পাগলামি বলেছিলেন; এমনকি তাঁর স্ত্রী মজিদাও। সবার চোখে মোতালেবের ‘পাগলামি’ চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন পৈতৃক ১০ কাঠা জমিতে ২৭৫টি খেজুর-বীজ বপন করেন।


উৎকণ্ঠার চার বছর: ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বছরগুলো ছিল মোতালেবের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তাঁর ‘পাগলামি’ দেখে চারপাশের মানুষ ভৎর্সনা করত। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। এই চার বছর তিনি নিয়মিত খাওয়া-দাওয়াও করতেন না। থাকতেন মূল বসতবাড়ি থেকে বিছিন্ন বাগানের একপাশের একটি চালাঘরে। স্বপ্ন দেখতেন একদিন তাঁর বাগানে আরবি খেজুর ফলবেই। উৎকণ্ঠার অবসান হয় ২০০৬ সালে। তিনটি গাছে ফলন হয়। অবিকল সৌদি আরবের খেজুর। প্রতিটি খেজুরের ওজন ৩৫-৪০ গ্রাম। তিনটি গাছে সাত কেজি খেজুর হয়। সব খেজুর মোতালেব খাওয়ালেন পাড়া-পড়শি আর দুই-তিন গ্রামের মানুষকে। কিন্তু বিচিগুলো রেখে দিলেন চারার জন্য।


নতুন উদ্যমে পথচলা: দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে ফলন হয় সাতটি গাছে। সেবার প্রতিটি গাছে গড়ে ২০ কেজির মতো খেজুর ধরে। এর পর থেকে প্রতিবছর খেজুরের ফলন বাড়তে থাকে। কিন্তু মোতালেব ২০১১ পর্যন্ত শুধু মানুষকে খেজুর খাইয়ে গেছেন। আর সেই বীজ থেকে প্রতিবারই নতুন চারা উৎপাদন করেছেন। বর্তমানে তাঁর এক একর ৩২ শতাংশ বাগানে ৫২০টি গাছ ও পলিব্যাগে প্রায় পাঁচ হাজার চারা আছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখন কৌতূহলী মানুষ তাঁর বাগান দেখতে আসেন। অনেকেই একটি-দুটি চারাও নিয়ে যান। মোতালেবের খেজুর বাগান নিয়ে প্রথম আলোতে ২০০২ ও ২০০৬ সালেদুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।


বাণিজ্যিকীকরণ ও খেজুর বিপ্লবের সম্ভাবনা: ২০০৮ সাল থেকে খেজুরের চারা বিক্রি শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর খেজুর বিপ্লব যেন একদিন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের আগস্টে তাঁর বাগানের আটটি বড় গাছে প্রায় ৫০০ কেজি খেজুর ফলে। লোকজন তাঁর বাগান থেকেই সেই খেজুর কিনে নিয়ে যায়। এ ছাড়া আকৃতিভেদে প্রতিটি চারা তিনি বিক্রি করছেন ৫০০ থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত।


বাণিজ্যিকভাবে চারা ও খেজুর বিক্রির প্রথম বছর তাঁর হাতে আসে প্রায় তিন লাখ টাকা। মোতালেবের ধারণা, আগামী মৌসুমে তাঁর আয় দাঁড়াবে দ্বিগুণ। আগামী পাঁচ বছরে দেশে সৌদি-খেজুরের বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন তিনি। বাগানের যত্ন ও খরচ সম্পর্কে মোতালেব জানান, জৈব সার প্রয়োগই বাগানের প্রধান যত্ন। আর জৈব সার হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন গোবরকে। এ ছাড়া বছরে একবার রাসায়নিক সার হিসেবে পটাশ ও টিএসপি প্রয়োগ করেন।


কৃষিবিদদের কথা: ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রহিম জানান, মোতালেব হোসেনের খেজুর বাগানের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময়। এ ক্ষেত্রে মাতৃগাছ থেকে শাখা কলম পদ্ধতির মাধ্যমে চারা নির্বাচন করতে হবে। তাতে ফলনের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করলে অনেক পুরুষ গাছ হতে পারে, যেগুলো ফলন দেবে না।


ভালুকা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমানও মোতালেবের খেজুর বাগানের সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি জানান, শুধু ময়মনসিংহের ভালুকাতেই নয়, লাল মাটির অঞ্চল সিলেট, এমনকি কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলেও এ রকম খেজুর চাষে সফলতা পাওয়া সম্ভব।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...