পাঙ্গাশ একটি সুস্বাদু মাছ। এ দেশের মানুষের অতি প্রিয় মাছ। এর বাজারমূল্য ও চাহিদা অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সব নদীতেই একসময় পাঙ্গাশ প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যেত। আমাদের দেশে পাঙ্গাশ মাছ এখনো নদী ও হাওর-বাঁওড় থেকেই ধরা হয়ে থাকে।
১৯৯০ সালে থাইল্যান্ড থেকে পাঙ্গাশিয়াস সূচি পোনা আকারে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। পরে মৎস্য বিভাগ কর্তৃক সরকারি কয়েকটি মৎস্য বীজাগারে এ পোনা লালন-পালনের ব্যবস্খা গৃহীত হয়। তিন বছর পরিচর্যার পর ১৯৯৩ সালে দেশী ও বিদেশী প্রজাতির পাঙ্গাশ একক ও মিশ্রচাষ, উপরন্তু বিদেশী প্রজাতির থাই পাঙ্গাশের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে এ দেশেই পাঙ্গাশের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে পাঙ্গাশের যে প্রজাতি পাওয়া যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম পাঙ্গাশিয়াস। বর্তমানে দেশী প্রজাতি অত্যন্ত দুর্লভ, তাই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদেশী প্রজাতির পোনা দ্বারা অনায়াসে দেশী প্রজাতির অভাব লাঘব করা যেতে পারে। বিদেশী প্রজাতির থাই পাঙ্গাশের পোনা পুকুর-দিঘিতে চাষের ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষের জন্য হতে পারে বাড়তি আয়ের চমৎকার উৎস।
পাঙ্গাশ প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। এটি রাক্ষুসে স্বভাবের নয় বলে রুইজাতীয় মাছের সাথেও চাষ করা সম্ভব।
এ মাছ পুকুরে ছাড়ার আগে যথা নিয়েমে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হয়। পুকুর প্রস্তুতির পর্যায়গুলো হচ্ছে, জলজ আগাছা পরিষ্কার করা, রাক্ষুসে মাছ অপসারণ, কীটপতঙ্গ দমন, চুন ও জৈব-অজৈব সার প্রয়োগ। ৬ ফুট থেকে ৮ ফুট গভীর পুকুর পাঙ্গাশ চাষের জন্য সর্বোত্তম। ৫ শতাংশ থেকে ১.০০ একর পর্যন্ত আয়তনের জলাশয় কাংক্ষিত ফল লাভে সহায়ক।
পুকুরে এককভাবে অথবা অন্য প্রজাতির মাছের সাথে যৌথভাবে পাঙ্গাশ চাষ করা যেতে পারে। রুইজাতীয় মাছের সাথে চাষ করা অধিক লাভজনক। পাঙ্গাশ পানির নিচের স্তরে থাকে বিধায় নিচের স্তরের খাদ্য খায় এমন মাছ যথা মৃগেল, কালিবাউশ, কার্পিও ইত্যাদি আনুপাতিক হারে পুকুরে কম ছাড়া উচিত।
পাঙ্গাশের একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ ৫-৮ সেন্টিমিটার সাইজের ৫০-৬০টি পোনা মজুদ করা যায়। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৫-৮ সেন্টিমিটার আকারের সিলভার কার্প ৮-১০টি, কাতল ৫-৬টি, রুই ১০-১২টি এবং পাঙ্গাশের পোনা ১৭-২২টি ছাড়া যেতে পারে।
মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের (প্লাঙ্কটন) পাশাপাশি সম্পূরক খাবার সরবরাহ করা জরুরি। খাবার হিসেবে প্রতিদিন সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, আটা ও ফিস মিলের (৩০: ৩০: ২০ : ১০ : ১০ আনুপাতিক হারে) মিশ্রণ তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত পুকুরে চাষকৃত মাছের মোট ওজনের শতকরা দুই থেকে পাঁচ ভাগ হারে প্রতিদিন সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।
এ মাছের ক্ষেত্রে খাবারে প্রাণিজ আমিষের উপস্খিতি একান্ত বাঞ্ছনীয়। তাই ফিস মিলের পরিবর্তে শামুক, ঝিনুক, পশুর নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদিসহ জমাট রক্তের গুঁড়া খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলে প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের স্বল্পতা দেখা দিলে নিয়মমাফিক জৈব-অজৈব সার প্রযোগ করতে হবে। পানি সবুজ বর্ণ ধারণ করলে সার প্রয়োগ বìধ রাখা অপরিহার্য। পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ, মাছের স্বাস্খ্য পরীক্ষা ও গ্যাসজনিত সমস্যা দূরীকরণে প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার পুকুরে জালটানা একান্ত প্রয়োজন।
উল্লিখিত পদ্ধতিতে চাষ করা হলে সর্বাধিক এক বছরে পাঙ্গাশ মাছ গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে। এর সাথে চাষকৃত অন্যান্য প্রজাতির মাছও যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জন করে। তবে যথাযথ যত্ন পরিচর্যায় ৫-৬ মাসে একটি পাঙ্গাশ গড়ে ৫০০ গ্রাম ওজনের আকারে পৌঁছতে পারে অতি সহজেই। এ আকৃতির মাছ বাজারে বিক্রিযোগ্য। নিয়মিত আহরণ করে বাজারজাত করা হলে পুকুরের অবশিষ্ট মাছ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধির সুযোগ পাবে। এভাবে চাষ করে একই পুকুরে বছরে পাঙ্গাশের দু’টি ফলন পাওয়া সম্ভব, যা বাণিজ্যিক দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উপরিউক্ত পদ্ধতিতে পাঙ্গাশের মিশ্রচাষ করে প্রতি একরে বছরে ২-৩ টন বা ৫০-৭০ মণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এক একর জলাশয় থেকে পুকুর সংস্কার, পুকুর প্রস্তুতি, মূলধনের ব্যাংক সুদ ইত্যাদিসহ বিবিধ খরচ বাদে বছরে প্রকৃত মুনাফা দাঁড়ায় সর্বমোট ৭৮ হাজার ৬৮০ টাকা।