পাট - সোনালী সম্ভাবনা

একটা সময় ছিল যখন সোনালী আঁশের দেশ বলতে বাংলাদেশকেই চিনত সারা পৃথিবীর মানুষ। শতকরা ৮০ ভাগ পাট উৎপন্ন হতো বাংলাদেশে যা ছিল রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সে সোনালী আশের আজ করুণ দশা। সময়োপযোগী সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কাঁচামালের অভাব, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর নানা অনিয়ম- গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস 

 

বিশৃঙ্খলা এবং প্রয়োজনীয় অর্থায়নের অভাবে সোনালী আঁশের পাট শিল্প আজকালের স্মৃতি হতে বসেছে। কিন্তু একটু সতর্কতা, মেধা, প্রযুক্তি ও ইচ্ছার সমন্বয়ের মাধ্যমে এ অমিত সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব এবং দেশকে দেয়া সম্ভব সমৃদ্ধি, সচ্ছলতা ও উন্নত রাষ্ট্রের রূপ। যুগোপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাটের আশের বিকল্প ব্যবহার সোনালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে পারে। শুধু আঁশ এবং পাটকাঠির ব্যবহারে কিন্তু পাটের গুণাগুণ সীমাবদ্ধ নয়।


নানাবিধ এবং অত্যন্ত জরুরি শিল্পজাত দ্রব্য তৈরিতে পাটের ভূমিকা হতে পারে একচ্ছত্র আধিপত্যের মতো। যেমন- বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীর রূপান্তরিত করা যায় 'প্লাস্টিক ফাইবার' জাত পণ্যে যা প্লাস্টিক কাঁচামাল ও পাটের আশের সমন্বয়ে তৈরি এবং এ প্লাস্টিক ফাইবার পণ্য অনেকাংশে পরিবেশবান্ধবও বটে। সব মিলিয়ে পাটভিত্তিক প্লাস্টিক ফাইবার বা বায়ো-কম্পোজিট পণ্য থেকে বাংলাদেশ প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা উপার্জন করতে পারবে প্রতিবছর।


তৈরি হবে আলাদা পাটভিত্তিক প্লাস্টিক ফাইবার বাজার, মজবুত হবে জাতীয় অর্থনীতি। বেশ কিছুদিন আগে 'মাল্টিপুল ইউটিলাইজেশন অফ ন্যাচারাল ফাইবার জুট ফর প্রোডাকশন অফ এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি বায়ো-কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টস ইন বাংলাদেশ ইউজিং কানাডিয়ান টেকনোলজি' প্রকল্পের অধীনে কানাডিয়ান প্রযুক্তির সাহায্যে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব পাট আশভিত্তিক বায়ো-কম্পোজিট শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের কানাডিয়ান এক বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফরে এসেছিল।


তারা প্লাস্টিক ফাইবার বা বায়ো-কম্পোজিট শিল্পজাত দ্রব্যের বাণিজ্যিক উৎপাদন, ব্যবহার ও সমপ্রসারণে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে জড়াতে চান। কারণ আমরা ভুলে গেলেও উন্নত দেশের সচেতন বিজ্ঞানী বা মানুষ এখনো বাংলাদেশকে সোনালী আশের দেশ হিসেবে চেনে ও জানে। এ দেশে পাটের প্রতুলতা, পাটজাত দ্রব্যের বর্তমান ব্যবহার এবং পাটজাত পণ্যের বিকল্প ব্যবহারে ঈর্ষণীয় সাফল্যের সম্ভাবনা তাদের আকৃষ্ট করেছে।


বাংলাদেশ প্রথাগতভাবে সহজলভ্যতার কারণে অনেক দিন ধরে পাট ও চা রপ্তানি করে আসছে। কিন্তু এখন   সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের তৈরিকৃত পোশাক ও চামড়াজাত পণ্য বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পাট, চামড়া ও টেক্সটাইল মিলগুলোতে এবং গার্মেন্টে চিকন সুতা, নভোসেল সুতা (পাট উল) যা পশমি বা কৃত্রিম আঁশের বিকল্প, নিটিং সুতা, ফার্নিসিং সুতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, সোয়েটার, জায়নামাজ, ব্যাগ, অগি্নরোধী বস্ত্র, পাটের শপিং ব্যাগ, পচনরোধী নার্সারি ব্যাগ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে এবং সঠিক পরিকল্পনায় আরো বেশি সফলভাবে রাখতে পারে।


আরো বিকল্প ব্যবহার যেমন- লাগেজ ব্যাগ, জ্যাকেট, কম্বল, মাফলার, টুপি, সোফা সেট, বেড শিট ইত্যাদিতে পাটের ব্যবহার করা যেতে পারে। বড়ি বা বাসার বুনন শিল্পে পাট বড় ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন কারুশিল্পে পাটের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব। এমনকি তুলা ও অন্য সুতার সঙ্গে পাট আশ মিশিয়ে মানসম্মত টেক্সটাইল সুতা তৈরি সম্ভব। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাটপণ্য বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে।


ফলে পাটের ব্যবহার শুধু বস্তা, চট, দড়ি আর কার্পেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পাট এখন ফ্যাশন ও বিলাসী পণ্যের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে পাট দিয়ে নানা ধরনের ইয়ার্ন ফাইবার ও ফেব্রিক জাতীয় শতাধিক পণ্য উৎপাদন করছে। এর মধ্যে ফাইবার জাতীয় পণ্যের মধ্যে রয়েছে জুট কম্পোজিটস, পেপার, পেপার প্রোডাক্টস, পাল্প, মেডিকেয়ার টেক্সটাইলস, নন-ওভেন প্রোডাক্টস উইপস, সেলুলোজ, বন্ডিং মেটেরিয়ালস, ফ্লোর টাইলস, সিএমসি, এমসিসি, টেকনিক্যাল ফাইবারস, প্যানেলস, সিটস ইত্যাদি।


ইয়ার্ন জাতীয় পাটজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ডায়েড ইয়ার্ন, ফাইনার ইয়ার্ন, পলিসড ইয়ার্ন, ফেন্সি ইয়ার্ন, কোর ইয়ার্ন, ফিউজড ইয়ার্ন, কেবল ইয়ার্ন, নিটেট ব্যাগ, হামক, স্যান্ডেল, জুতা, জুতার বিভিন্ন অংশ ইত্যাদি। এছাড়া পাটের তৈরি ফ্রেবিক জাতীয় পণ্যেও মধ্যে রয়েছে চেকড ফেব্রিক, লাইট ফেব্রিক, ডিজাইনড ফেব্রিক, ট্রিটেট ফেব্রিক, লেমিনেটেড ফেব্রিক, ইউনিয়ন ফেব্রিক, প্রিন্টেট ফেব্রিক, গিফট রঙ, সুটকেস, ব্রিফকেস, সেমিনার ব্যাগস, ফাইলস, ফোল্ডার ইত্যাদি। এ বিষয়ে কানাডিয়ান বিশেষজ্ঞ দলের সাথে আলাপ হলে টিম লিডার প্রফেসর আরএল কেশোয়া বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক কাঁচামালের সাথে যদি শতকরা ৪০ ভাগ পর্যন্ত পাট আঁশের যোগ করা হয় তবুও প্লাস্টিকের বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকে এবং এ থেকে উৎপাদিত পণ্য আরো উন্নত বাহ্যিক কাঠামো ধারণ করে। সাসক্যাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ডিরেক্টর ড. এম পোর্টার বলেন, শতরা ১০০ ভাগ প্লাস্টিক কাঁচামালের পণ্য ব্যবহার করলে মাটিতে শুধু প্লাস্টিকই জমা হবে যা পরিবেশের ক্ষতি করে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...