সোনাতলার উত্তর গোসাইবাড়ী গ্রামে সড়কের পাশে নিজের লাগানো গাছ থেকে কাঁঠাল পাড়ছেন সরোয়ার জাহান |
প্রতিবেশীরা যখন নানা ফলভর্তি ডালি নিয়ে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতেন, ছেলেমেয়েরা তা দেখে বাড়ি এসে ফলের আবদার করত। সামর্থ্যের অভাবে সন্তানদের মুখে ফল তুলে দিতে না পারায় খুব কষ্ট লাগত। নিজের সন্তানদের কথা ভাবতে গিয়ে গরিব প্রতিবেশীর সন্তানদের কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। একসময় মনে হলো, তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। কিছুদিন পর বাড়ির পাশের সড়কের দুই পাশে বাগান করার সিদ্ধান্ত নেন।
এভাবেই ফলের গাছ লাগানো শুরু করেছিলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার উত্তর গোসাইবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা, গোসাইবাড়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরোয়ার জাহান (৫৪)। ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করা সরোয়ার একসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। স্ত্রী ও আট ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর বড় সংসার।
১৯৯৮ সালে প্রথমে তিনি গাবতলী-সোনাতলা সড়কের পাশে কয়েক হাজার লেবু গাছ লাগান। দুই বছরের মাথায় এসব গাছে লেবু ধরে। এলাকার লোকজন লেবু তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যা থাকত তা বিক্রি করে বছরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় হতো। ২০০১ সালে লেবু বিক্রির টাকায় সড়কের চরপাড়া বাজার থেকে গোসাইবাড়ী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারে দুই পাশে লেবু গাছের ফাঁকে ফাঁকে আড়াইশ কাঁঠাল ও জলপাইগাছ লাগান। এরপর লেবু গাছ গুলো তুলে ফেলা হয়। ২০০৮ সাল থেকে গাছে কাঁঠাল ও জলপাই ধরতে শুরু করে। এলাকার গরিব মানুষ এগুলো পেড়ে নিয়ে যায়। এসব দেখে সরোয়ারের মন আনন্দে ভরে ওঠে। প্রায় ১০ বছর ধরে তাঁর লাগানো গাছ থেকে বিনা পয়সায় ফল খাচ্ছে এলাকার গরিব মানুষ।
গত মঙ্গলবার গাবতলী-সোনাতলা সড়কে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার দুই পাশে কাঁঠাল ও জলপাই গাছ। গাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি কাঁঠাল গাছে ৫০ থেকে ৬০টি করে কাঁঠাল ধরেছে। জলপাই গাছে ফুল এসেছে। গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে অনেককেই বাড়ি ফিরতে দেখা গেল।
এলাকাবাসী জানান, গাছ লাগিয়ে ফল খাওয়ার সুযোগ করে দিতে প্রথমে সরোয়ার জাহান এগিয়ে এসেছিলেন। বর্তমানে সুখান পুকুরের জহির রায়হানসহ বেশ কয়েকজন লোক এমন দৃষ্টান্ত মূলক কাজে এগিয়ে এসেছেন।
সরোয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তার পাশে ফলের গাছ লাগাতে এসে মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। ভালোবাসার টানে গত নির্বাচনে লোকজন আমাকে ইউপি সদস্য পদে দাঁড় করিয়ে দেন; বিপুল ভোটে বিজয়ীও করেছেন। একসময় তিন বেলা খেতে পারতাম না। এখন রাস্তার পাশে বাদেও বসতভিটা ও নিজের জমিতে আরও প্রায় সাড়ে ৭০০ ফলদ ও বনজ গাছ লাগিয়েছি, যার দাম প্রায় কোটি টাকা। এলাকাবাসীর খাওয়ার পরও অনেক ফল থেকে যায়। সেগুলো বিক্রি করে বেশ আয় হয়। আয়ের টাকায় তিন মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছি।’
সরোয়ার জানান, শুরুর দিকে এলাকাবাসী যে যার মতো ফল পেড়ে নিত। এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ায় এখন তাঁর কাছে বলে ফল নিয়ে যান। সরোয়ার এখন প্রতিদিনই মানুষকে পরামর্শ দেন, বিড়ি-সিগারেট-চা-পানের পয়সা বাঁচিয়ে বাড়িতে ফলের দুটি গাছ লাগান। পরিবারের ফলের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পরিবেশ বাঁচান। তাঁর স্ত্রী জিন্নাত মহল বলেন, সড়কে সড়কে গাছ লাগানোকে একসময় পাগলামি ভাবতাম। এখন বুঝি, গাছ লাগিয়ে সে শুধু মানুষের উপকারই করেনি, নিজের সংসারের অভাবও তাড়িয়েছে।’
জোড়গাছা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, এটা অনুকরণীয় এবং দৃষ্টান্ত মূলক উদ্যোগ। সরকারি রাস্তায় গাছ লাগিয়ে তিনি গরিব মানুষের মুখে ফল তুলে দিচ্ছেন। তাঁর এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মঈন উদ্দীন বলেন, ‘ওই সড়ক এলজিইডির হলেও মানুষকে ফল খাওয়ানোর জন্য সরোয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয় এবং পরিবেশের জন্য ভালো। আমাদের সড়কের পাশে অন্য কেউ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিলে তা সাদরে গ্রহণ করব।’
সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, উদ্যোগটা খুবই ভালো। এ ধরনের ভালো কাজে আরও বেশি বেশি এগিয়ে আসার জন্য তিনি সরোয়ারকে উৎসাহিত করবেন।