বাউকুল - চাষ

বাংলাদেশের আবহাওয়া কুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। জলাবদ্ধতাহীন যে কোন মাটিতে বাউকুল চাষ করা যায়। এই গাছের জীবনীশক্তি অনেক। অল্প পুঁজি, অল্প জমি এবং অল্প সময়ে বাউকুল চাষ করে সফলতা আনা সম্ভব।


বাউকুল চাষের মাধ্যমে এক বিঘা (ত্রিশ শতাংশ) জমি থেকে ছয় বছরে সম্ভাব্য নু্ন্যতম আয় ১৮-২০ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়াও বিভিন্ন সাথী ফসল তো আছেই। চারা লাগানোর প্রথম বছর ছাড়াও প্রতি বছর গাছ ছাঁটার পর জমি ফাঁকা হয়ে যায়। তখন মৌসুমী সবজি চাষ করে কুল বাগানের বাৎসরিক পরিচর্যা খরচ উঠিয়ে নেয়া সম্ভব। এই সময়টুকুতে বেগুন, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়শ, অথবা হাইব্রিড ধনেপাতার চাষ করা যায় ।


ছয় বছরে আয়-ব্যয়ের হিসাবটুকু একটু মিলিয়ে নেয়া যাক। সে আলোকে নিম্নে সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের ছক দেখানো হলো।


এক বিঘা জমিতে কুল চাষ করতে প্রথম বছর চারার দরকার হয় ১৫০টি। সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ছয় ফুট। তিন বছর পর দুটি গাছের মাঝ থেকে একটি গাছ উঠিয়ে ফেলতে হবে এবং গাছের সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৫টি। উপরোক্ত হিসেব অনুযায়ী ছয় বছরে এক বিঘা জমি থেকে নীট লাভ ১৭,৬২,০০০/- টাকা।


কোথায়, কখন কীভাবে চাষ করবেন:

আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র জলাবদ্ধতাহীন জমিতে বাউকুল চাষ করা যাবে। পাহাড়ের ঢালে, পুকুর পাড়ে, কিংবা বালুময় চরাঞ্চলে বাড়ির আঙ্গিনায় রৌদ্রজ্জ্বল স্থানে এমনকি আপনার বাড়ির ছাদে টব কিংবা ড্রামে। মধ্য মে থেকে মধ্য আগষ্ট পর্যনত্দ কুলের চারা রোপনের উৎকৃষ্ট সময়। এছাড়াও পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই কুলের চারা রোপন করা যায়।


রোপন পদ্ধতি :


১. সাধারণ : সামপ্রতিক মাঠ গবেষণায় দেখা গেছে পাহাড়ের লাল মাটি, পুকুর পাড়, বাড়ির আঙ্গিনা এবং অসমতল অনাবাদী জমি ব্যতীত অন্যান্য ফসলি জমি যেমন, এঁটেল, দো-আঁশ, পলি মাটিতে গর্ত করে মাদা তৈরি করার প্রয়োজন হয় না। এ ধরণের জমি তৈরিতে শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি ৬০ কেজি টিএসপি, ৩০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি এমওপি, ৬০ মণ পঁচা গোবর ও দুই কেজি পাউডার সোহাগা প্রয়োগ করে মই দিয়ে জমি সমান করতে হবে এবং প্রতি ১২ ফুট অনত্দর ১৫ ইঞ্চি প্রস্থ ৬ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করে নালার মাটি উভয় পাশে ছিটিয়ে দিয়ে সমসত্দ জমিতে ১২ ফুট প্রস্থের বেড তৈরি করতে হবে। এর এক সপ্তাহ পর প্রতি বেডের মাঝখানে ৬ ফুট অনত্দর চারা রোপন করতে হবে।

 

২. মাদা তৈরি : সারি থেকে সারি ১২ ফুট এবং চারা থেকে চারা ছয় ফুট দূরত্বে চারা রোপনের লক্ষ্যে আপনাকে উল্লেখিত দূরত্বে দুই ফুট দূরত্বে দুই ফুট দৈর্ঘ্য, দুই ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট গভীর গর্ত করতে হবে। গর্ত থেকে উত্তোলিত মাটির সাথে ২০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০গ্রাম এমওপি, ১০০ গ্রাম সরিষার খৈল ও ১০ গ্রাম পাউডার সোহাগা এবং ১৫-২০ কেজি পঁচা গোবর ভালভাবে মিশিয়ে গর্তের পাশে ঢিবি করে রেখে দিতে হবে এক সপ্তাহ। তারপর সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্তটি ভরাট করার দুই সপ্তাহ পর কুলের চারাটি রোপন করে একটি কাঠি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। কলমকৃত অংশের নীচ থেকে গজানো ডাল বা কুশি সবসময় কেটে দিতে হবে। নতুবা জংলি গাছের প্রভাবে কলম চারাটি মারা যেতে পারে।

 

৩. ড্রামে বা টবে চাষ : এক্ষেত্রে সমপরিমাণ মাটি ও পঁচা গোবর ভালভাবে মিশিয়ে ড্রাম বা টবটি ভরাট করে দুই সপ্তাহ রেখে দিয়ে চারা রোপন করতে হবে এবং ১৫ দিন চারটি সিলভামিক্স ট্যাবলেট গাছের তিন ইঞ্চি গভীরে পুঁতে দিতে হবে। এইভাবে ফুল আসার সময় আর একবার সিলভামিক্স ট্যাবলেট প্রয়োগ করতে হবে।


টব/ অর্ধড্রামে কুলের চাষঃ

  • প্রথমে টবের তলায় ১ ইঞ্চি পরিমাণ ইটের খোয়া, পচাঁ পাতা এবং খড় বিছিয়ে দিতে হবে।
  • পুরো টব বা ড্রামটি সমপরিমান পচাঁ গোবর ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রন দিয়ে ভরে দিতে হবে।
  • এবার টবের মাঝ খানে একটি সুস্থ্য ও সবল কলম রোপন করতে হবে। এ জন্য কোন প্রকার রাসায়নিক সারের দরকার নাই।
  • তবে গাছের কচি পাতা বের হয়ে তা পরিপক্ক হলে ২-৩ টি সিলভা মিক্স ট্যাবলেট সার গাছের গোড়া হতে ৫-৭ সে.মি. দুরে ৫-৭ সে.মি. মাটির গভীরে পুতে দিতে হবে।
  • গাছের প্রয়োজন অনুসারে সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভালভাবে যত্ন করলে এক বছরের বয়সী গাছ থেকে হেক্টর প্রতি ৮-১২ টন ফলন পাওয়া যায়।

 

উপরি প্রয়োগ :
বাগান সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা লাগানোর পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে এবং গাছে ফুল আসার আগে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও গাছের বৃদ্ধি কম হলে প্রথম প্রয়োগের ৪০ দিন পর গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

প্রথম উপরি প্রয়োগ :
গাছ প্রতি ইউরিয়া ৫০ গ্রাম, এমওপি ৫০ গ্রাম এবং খৈল ৫০ গ্রাম একসাথে মিশিয়ে গাছের ছয় ইঞ্চি দূরত্বে রিং প্রয়োগ করে হালকা নিড়ানি দিয়ে মাঠের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছ প্রতি ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, এমওপি ৫০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ গ্রাম এক সাথে মিশিয়ে গাছের ৬ ইঞ্চি দূরত্বে প্রয়োগে হালকা নিরানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

 

প্রতি বছর কুল ওঠানোর পর মার্চ মাসের শেষের দিকে গাছগুলোর আকার অনুসারে ৩-৫ ফুট উচ্চতায় মূল কাণ্ডটি রেখে সব ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং বাগানের মাটি হালকা করে কুপিয়ে প্রথমবার জমি তৈরির মত গোবর ও অন্যান্য সার পরিমাণ মত প্রয়োগ করে নালাসহ বেড তৈরি করে দিতে হবে।


রোগবালাই :

যথেষ্ট প্রতিকূলতা সহনশীল কুল গাছ সাধারণত বিছাপোকা, লাল ক্ষুদ্র মাকড়সা, কাণ্ড ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ও এক ধরণের ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়।


প্রতিকার :

বিছাপোকা ও অন্যান্য পাতাখেকো পোকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে দুই মি.লি. পাইরিফ্স জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে সমস- গাছে স্প্রে করে দিতে হবে। মাকড়শা দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতি লিটার পানিতে দুই টাফগড় সাথে দুই গ্রাম থেয়োভিট মিশিয়ে সপ্রে করতে হবে। কাণ্ড ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে প্রতি লিটারে এক মি.লি. হারে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সপ্রে করতে হবে। ছত্রাকের আক্রমণ হলে প্রতি লিটার পানিতে কার্বেনডাজম এবং দুই গ্রাম মেনকোজেব ভালভাবে মিশিয়ে সমস্ত- গাছে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া অধিক ফলনের জন্য ফুলে লিটুনেস বা এ্যাগনল এবং ভালমানের পিজিআর ব্যবহার করুন। পরিশেষে পরিপক্ক ডাসা কুল সংগ্রহ করে টাটকা অবস্থায় বাজারজাত করুন।




HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...