হাঁস - দুটি হাঁস থেকে ২ কোটি টাকার মালিক
শাহজাহান সোহেল, সাদুল্যাপুর (গাইবান্ধা)

রূপকথার গল্পে রোজ ভোরে সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁসের কথা জেনেছেন অনেকে; কিন্তু বাস্তবে কি সোনার ডিম দেওয়া মূল্যবান হাঁসের কথা ভাবা যায়! অভাবনীয় হলেও বাস্তবে তেমনই এক বিস্ময়কর সাফল্যের ঘটনা ঘটেছে। দুটি হাঁস থেকে ২ কোটি টাকার মালিক হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটিয়েছেন হাবিবুর রহমান। তার কথা শুনলে অবাকই হতে হয়।


'হাঁসের শরীরে হাত দিলেই আমি বুঝতে পারি হাঁস ডিম দেবে কি-না' এটি কোনো চিকিৎসকের মন্তব্য নয়, এটি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হাঁস খামারি হাবিবের অভিজ্ঞতা। খামারি হাবিবুর রহমান সিলেট শহরের কুমুপাড়া এলাকার জালালউদ্দিনের ছেলে।


দুটি হাঁস থেকে ১২ বছরে (12 year) ২ কোটি (2 crore) টাকার মালিক বনে যাওয়া হাবিবুর রহমান হাঁসের পাল চরিয়ে বেড়ান বিল-ঝিলে। ভ্রাম্যমাণ খামারি হাবিবুর রহমান এবার ২ হাজার ১০০ (2100) হাঁস নিয়ে তাঁবু গেড়েছেন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের চকনদি গ্রামের বিলে। অর্থ উপার্জনের জন্য কীভাবে পরিশ্রম করতে হয়, কতটা ধৈর্য ধরতে হয়, এর সবটুকু করছেন রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে যাযাবরের মতো জীবনযাপনকারী হাবিবুর রহমান। এক যুগে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা হাবিবুরের হাঁসের খামার দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।


তিনি জানান, মায়ের পরামর্শে ১২ বছর আগে মাত্র দুটি হাঁস দিয়ে খামার শুরু করেন। এরপর আস্তে আস্তে পালে হাঁসের সংখ্যা বাড়তে থাকে; কিন্তু হাঁস পালনের জন্য নিজের জায়গা-জমি না থাকায় শুরু করেন যাবাবর জীবনযাপন। যেখানে বিল-ঝিল রয়েছে, সেখানেই ছুটছেন হাঁসের পাল নিয়ে। ভ্রাম্যমাণ খামারে জায়গা-জমির ভাড়া লাগে না, হাঁসের সমস্যা দেখা দেয় না। তাই অন্যের জমিতে হাঁস পালন করে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন হাবিবুর রহমান। উপার্জনের জন্যই হাঁসের খামার নিয়ে সিলেট থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাদুল্যাপুরে এসেছেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত মহাসড়ক সংলগ্ন প্রায় ২৫ জেলার বিল-ঝিলে হাঁসের খামার নিয়ে ঘুরেছেন। নিরাপত্তার কারণে বেশির ভাগ সময় মহাসড়কে পুলিশ বক্সের পাশে কিংবা ইটভাটার উঁচু মাটিতে তাঁবু গেড়ে হাঁসের পাল নিয়ে রাতযাপন করেন।


বিল-ঝিলে হাঁসের খাদ্যের সমস্যা হয় না। বছরে শুধু চার মাস (ফাল্গুন, চৈত্র, শ্রাবণ ও ভাদ্র) হাঁসের কিছু খাদ্য কিনতে হয়। এ ছাড়া বাকি আট মাস খাদ্য কিনতে হয় না। প্রকৃতিতে থাকা শামুক-ঝিনুক, পোকা-মাকড় খেলে হাঁস প্রচুর ডিম দেয় এবং রোগবালাই কম হয়। বদ্ধ পরিবেশে হাঁস কম ডিম দেয়। কাদামাটিতে হাঁস যত মুখ লাগাবে, ততো বেশি ডিম দেবে। তিনি নিজেই হাঁসের চিকিৎসা করেন। হাঁসের শরীরে হাত দিলেই বুঝতে পারেন হাঁস ডিম দেবে ও সুস্থ কি-না। সরকারি-বেসরকারি কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি এ পর্যায়ে এসেছেন বলে জানান হাবিব। হাঁসের সঙ্গে থাকতে থাকতেই তার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। তাই তিনি রাতে হাঁসের পালের সঙ্গেই তাঁবু গেড়ে ঘুমান। রাতে হাঁসগুলো নির্ধারিত বেষ্টনীতে (খোলা আকাশের নিচে বানা দিয়ে ঘেরা) থাকে। সকালে ডিম বের করার আগে হাঁসগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়।


হাবিবুর রহমান বলেন, হাঁসগুলো তিন ভাগ করে (৭০০ করে) পাশাপাশি তিনটি বিলে রাখা হয়। তিন গ্রুপে দু'জন করে বেতনভুক্ত কর্মচারী রয়েছেন। খামারের হাঁস গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ (1500) থেকে ১ হাজার ৬০০ (1600) ডিম দেয়। সে ডিম ৯ (9) থেকে ১০ (10) হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পলাশবাড়ী উপজেলা সদরের পাইকার বাদশা মিয়া প্রতিদিন ডিম কেনেন। দীর্ঘদিন ধরে এ পাইকার তার ডিম কেনেন। কর্মচারীর বেতন এবং অন্য খরচ বাদ দিয়ে গড়ে প্রতি মাসে তার ৫৫ (55) থেকে ৬০ (60) হাজার টাকা আয় হয়। তিনি সবসময় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেন। রাতে তাঁবুতে থাকার কারণে শুধু খরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা কাছে রাখেন। হাঁসের খামার নিয়ে যখন যেখানেই যান, সেখানকার চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ গ্রামপুলিশ এবং সুধীজনের সাহায্য নেন। বিনিময়ে তাদের তিনি খুশি হয়ে ডিম উপহার দেন। এলাকার মানুষের এ সাহায্যের কারণে এখনও তিনি কোথাও কোনো প্রকার হুমকি-ধমকি, আর্থিক বা অন্য কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হননি। এ ছাড়া এখনও তিনি কোনো চাঁদাবাজি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের শিকার হননি বলে জানান।


তিনি আরও বলেন, বড় হাওর-বাঁওড়ে বেশি পানি এবং স্রোতের কারণে হাঁসের খাবারের সমস্যা হয়। তাই ছোট বিল-ঝিলে হাঁসের পাল নিয়ে ঘোরেন। দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে বেশি ছোট বিল রয়েছে। তাই হাঁসের পাল নিয়ে এসব এলাকায় অবস্থান করছেন। বেশি দূরত্বের বিলে গেলে ট্রাকযোগে হাঁস পরিবহন করেন। হাবিবুর রহমানের খামারের হাঁস এতটাই পোষ মেনেছে যে, তিনি হাঁসগুলোকে যখন যেদিকে যেতে বলেন সেদিকেই যায়। যেন হাবিবুরের হাতের ইশারায় আর মুখের কথায় হাঁস ওঠা বসা করে। হাঁসের পোষ মানার কিছু দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে অন্যকে বিশ্বাস করানো যাবে না।


হাঁস খামারের আয়ের টাকায় হাবিবুর রহমানের ১০ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে। আয়ের টাকায় তিনি এ পর্যন্ত নেত্রকোনা শহরে বৃহৎ হাঁস খামার ও হ্যাচারি করার জন্য ছয় বিঘা জমি কিনেছেন। সিলেট শহরে সোহান-সোহাগ নামে একটি হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর হ্যাচারি দিয়েছেন। সেটি তার স্ত্রী শিউলি আক্তার লায়লা দেখাশোনা করেন। সেই হ্যাচারি থেকেও প্রচুর লাভ হয়। পরিবার নিয়ে থাকার জন্য সিলেট শহরে ইটের দালান (পাকা ঘর-দরজা) করেছেন। তার মতে, এ ব্যবসায় হালাল উপার্জনের মাধ্যমে খুব সহজে কোটিপতি হওয়া সম্ভব। তিনি দেশের বেকার যুবকদের হাঁস পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ধৈর্য সহকারে এ ব্যবসা করলে বেকার থাকতে হবে না; টাকার সমস্যায়ও পড়বে না কেউ।


খামারের কর্মচারী শফিকুর রহমান ও তমজিন ইসলাম বলেন, চার বছর ধরে এ খামারে কাজ করছি। হাঁসের সঙ্গে বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেরাও ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার করব। তাদের মতে, এ ব্যবসায় প্রচুর লাভ। প্রতিদিন নগদ টাকা হাতে আসে।


ধাপেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শিপন বলেন, হাঁসের খামার নিয়ে হাবিবুর রহমান তার এলাকায় আসার পর থেকেই দেখার জন্য মানুষ ছুটে আসছে। মানুষ এ খামার দেখে নিজেরাও হাঁস পালনে উৎসাহী হবে বলে তিনি আশাবাদী। সাদুল্যাপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রহমত-উন-নবী বলেন, সবার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। এটি এক ধরনের অসম্ভব কাজ। হাবিবুর রহমান কঠিন কাজ সহজ বানিয়ে সফলতা দেখিয়েছেন। এ হাঁসের খামার পরিবেশবান্ধব। অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে হাবিবুর রহমান একসময় হাঁসের খামারের জন্য দেশের মডেল হবেন।


সাদুল্যাপুর থানার ওসি আবু দিলওয়ার মোঃ হাসান ইনাম বলেন, হাঁস খামারি হাবিবুর রহমান তার এলাকায় থাকার কারণে নিরাপত্তা না চাইলেও হাইওয়ে পুলিশ তাকে সহায়তা করছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, এ ধরনের খামারিদের এলাকার সবারই সহযোগিতা করা উচিত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে মানুষ উৎসাহিত ও কর্মমুখী হবে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...