মিষ্টি মরিচ - চাষ

মিষ্টি মরিচ আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। ইদানীং বিভিন্ন বৃক্ষমেলায় ও রাস্তাঘাটে মিষ্টি মরিচের চারা বিক্রি করতে দেখা যায়। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ঝালযুক্ত মরিচ মূলত মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু ঝালবিহীন বা মিষ্টি মরিচের ব্যবহার সবেমাত্র শুরু হয়েছে এবং তা সবজি বা সালাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে টমেটোর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি হচ্ছে মিষ্টি মরিচ। এই মরিচ সালাদ ও সবজির পাশাপাশি সুপ তৈরি ও ভেষজ ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রচুর ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টিসমৃদ্ধ এই মরিচ টবে চাষের উপযোগী বলে শহুরে মানুষও শখ করে বাড়ির ছাদে, বারান্দার টবে এর চাষ করতে পারেন। শহরের কাছাকাছি স্বল্প জমির কৃষকরা এগুলো চাষ করে বড় বড় হোটেলে এবং আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রিও করতে পারেন। মিষ্টি মরিচ বাণিজ্যিক বা সৌখিন, যেভাবেই চাষ করেন না কেন ভালো ফলনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়ে ধারণা থাকা আবশ্যক।

 

মাটি জলবায়ু :

সব ধরনের মাটিতেই মিষ্টি মরিচ চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য উত্তম। মিষ্টি মরিচের জন্য মাটির পিএইচ ৫.৫-৭ এর মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

মিষ্টি মরিচ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব মৌসুমে চাষ করা যায়। তবে আমাদের দেশে শীতকালে তাপমাত্রা (১৬০-২৫০ সে.) কম থাকায় এই মরিচ চাষের জন্য অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসই উপযোগী সময়। কেননা রাতের তাপমাত্রা ১৬০ সে. এর ওপরে গেলে ফুল ও ফল ধারণ ব্যাহত হয়।

 

জাত নির্বাচন :

আমাদের দেশে ইয়োলো ওয়ান্ডার্স, ক্যালিফোর্নিয়া ওয়ান্ডার্স ইত্যাদি জাতের মরিচ চাষ করতে দেখা যায়।

 

চারা তৈরি :

আমাদের দেশে আজকাল নার্সারি মালিকরা আমদানিকৃত বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে সৌখিন মানুষ ও সাধারণ চাষির কাছে বিক্রি করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে চারা উৎপাদনকারী চাষি বা নার্সারি উৎপাদককে হাজার বীজের ওজন, বীজের মূল্য, বীজতলায় চারা উৎপাদন প্রযুক্তি এবং পলিথিনে স্খানান্তর কৌশল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে।

 

সাধারণত এক গ্রাম বীজে ১৫০-১৬০টি বীজ থাকে। সে হিসেবে হেক্টর প্রতি (সাড়ে সাত বিঘায়) ২৩০-২৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। এক হেক্টর জমিতে ৩০ হাজার চারার প্রয়োজন পড়ে। সুনিষ্কাশিত উঁচুস্খানের মাটি মিহি করে প্রয়োজনীয় জৈব সার প্রয়োগ করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বপনের আগে বীজগুলো ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। বীজতলায় সারি থেকে সারির দূরত্ব ১০ সে. মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ২ সে. মি.। ভিজানো বীজগুলো বপন করে হালকাভাবে মাটি চাপা দিতে হবে। বীজ গজানোর পর চারা ৩-৪ পাতাবিশিষ্ট হলে ১২.৭৫ ক ১০.১৫ সে. মি. আকারে পলি ব্যাগে স্খানান্তর করতে হবে। পলিব্যাগের জন্য তৈরি করা মাটি হলো ৩ ভাগ সাধারণ মাটি, ১ ভাগ কম্পোস্ট এবং ১ ভাগ বালুর মিশ্রণ। পলিব্যাগে চারা স্খানান্তরের পর পলিব্যাগ ছায়াযুক্ত স্খানে রাখতে হবে। যাতে প্রখর সূর্যালোক, ঝড়-বৃষ্টি আঘাত হানতে না পারে। উল্লেখ্য, অক্টোবর মাস বীজ বপনের উত্তম সময়।

 

মূল জমি তৈরি চারা রোপণ :

ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে এমনভাবে জমি তৈরি করতে হবে যাতে জমির মাটি মিহি হয়। মিষ্টি মরিচ চাষে হেক্টর প্রতি গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২২০ কেজি, টিএসপি ৩৩০ কেজি, এমপি ২২০ কেজি, জিপসাম ১১০ কেজি এবং জিংক অক্সাইড ৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। পরে বাকি অর্ধেক গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক অক্সাইড ১/৩ ইউরিয়া এবং ১/৩ অংশ এমপি গর্ত তৈরির সময় গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও এমপি পরে সমান দুই ভাগে ভাগ করে চারা লাগানোর ২৫ ও ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা ৫০ সে. মি. ক ৫০ সে. মি. রোপণ করতে হবে। চারা বিকেল বেলায় বা কম সূর্যতাপের সময় রোপণ করা ভালো। চারা রোপণের পর প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে।

 

আগাছা দমন, সেচ ও নিকাশ: হাত বা নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। যেহেতু মিষ্টি মরিচ খরা ও জলাবদ্ধতা কোনোটিই সহ্য করতে পারে না, তাই পরিমাণমতো সেচ দিতে হবে। যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সে জন্য সুষ্ঠু নিষ্কাশন ব্যবস্খা থাকতে হবে। গাছের হেলে পড়া রোধ করতে খুঁটির ব্যবস্খা করা যেতে পারে।

 

রোগবালাই দমন :

ঝাল মরিচের মতো মিষ্টি মরিচেও সাধারণত ছত্রাকজনিত রোগ এনথ্রাকনোজ, বস্নাইট, উইল্ট এবং ভাইরাসজনিত রোগ হয়ে থাকে। ছত্রাকজনিত রোগ দমনে ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে এমনভাবে স্প্রে করতে হবে যাতে গাছ ও গোড়ার মাটি ভিজে যায়। উইল্ট অর্থাৎ ডালপালা নেতিয়ে পড়া রোগ হলে জমিতে সেচ বাধ করে দেয়া উচিত। ভাইরাসজনিত রোগে পাতা কুঁকড়ে আসে এবং হলদে দাগ পড়ে। এ রোগের তেমন কেনো ওষুধ নেই। তাই গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলা উচিত। পোকার মধ্যে সাধারণত এফিড, থ্রিপস এবং মাইট ইত্যাদি আক্রমণ করে থাকে। দমন ব্যবস্খা হিসেবে এফিডের জন্য ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি, থ্রিপসের জন্য কুইনালকস জাতীয় (একালাক্স/ কিনালাক্স/ডায়াজিনন-৬০ ইসি) এবং মাইটের জন্য নিউরন ৫০ ইসি অথবা টর্ক ৫৫০ ইসি ২. মিলি. হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে পাতার নিচে ও উপরে স্প্রে করতে হবে।

 

ফসল সংগ্রহ ফলন :

মিষ্ট মরিচ সাধারণত সবুজ অবস্খায় খাওয়া হয়। তাই ফলের রঙ সবুজ বর্ণ থেকে লালচে হওয়ার আগেই সংগ্রহ করতে হবে। গাছ থেকে ফল তোলার সময় ফলের সাথে বোঁটা রেখে দিতে হবে। সপ্তাহে সাধারণত একবার ফল উত্তোলন করা যায়। সংগ্রহের পর থেকে বাজারজাত করার আগ পর্যন্ত মিষ্টি মরিচকে ঠাণ্ডা ও ছায়াযুক্ত স্খানে সংরক্ষণ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ইয়োলো ওয়ান্ডার্স জাতটি আমাদের দেশে হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন (বিঘায় ৪০ মণ) ফলন দিতে পারে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...