কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ সড়কের ঔষধি গাছগুলো এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে। বনজ বৃক্ষ রক্ষায় বন বিভাগ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কিন্তু ওই ঔষধি সড়কের গাছগুলো কোনো ধরনের পাহারা ছাড়াই ২০ বছর যাবত টিকে আছে। একটি গাছও চুরি হয়নি। এতেই প্রতীয়মান হয় এলাকার সাধারণ মানুষ ওই গাছের সুফল ভোগ করছে। প্রতিনিয়তই অর্জুন গাছের চামড়া (ছাল) কেটে নিয়ে এর রস পান করতে দেখা যায় এলাকার মানুষদের।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি চা বাগান থেকে ভানুগাছ বাজারসংলগ্ন ধলই নদীর ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক ও জনপদের ৪ কিলোমিটার রাস্তায় রোপণকৃত ৫ হাজার অর্জুন গাছ ওই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ওই গাছের ছাল আয়ুর্বেদী ওষুধ হিসেবে কাজে লাগছে ১০ গ্রামের সাধারণ মানুষের। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ওই সড়কের অর্জুন গাছগুলোকে কাজে লাগালে প্রতিবছর কমলগঞ্জ ঔষধি সড়কের অর্জুন গাছ থেকে লাখ লাখ টাকার আয়ুর্বেদী ওষুধের কাঁচামাল আহরণ সম্ভব। ফলে আয়ুর্বেদী ঔষধের কাঁচামাল আমদানি নয় বরং এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করা যাবে, যার ফলে দেশ অর্জন করতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। গত কয়েক বছর যাবত এলাকায় ঔষধি সড়ক হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক দেশের মডেল ভেষজ সড়ক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এ সড়কে রোপণকৃত ৫ হাজার অর্জুন গাছ এ এলাকার সাধারণ মানুষের উপকারে আসছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগ মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে সড়ক ও জনপদ বিভাগ, বন বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপকারভোগী এই চারপক্ষেয় অংশিদ্বারিত্ব চুক্তির ভিত্তিতে উপকারভোগী হিসেবে কমলগঞ্জ উপজেলার জব্বার মিয়া ও ইমরান মিয়া কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী চা বাগান এলাকা থেকে ভানুগাছ বাজারসংলগ্ন ধলই নদীর পুরাতন ব্রিজ পর্যন্ত মোট ৪ কিলোমিটার রাস্তায় প্রায় ৫ হাজার অর্জুন বৃক্ষের চারা রোপণ করেন।
সারাদেশে বন বিভাগ উপকারভোগী মনোনীত করে উপকারভোগীদের মাধ্যমে সড়কের পাশে, বন বিভাগের খালি জমিতে, হাওরাঞ্চলে গাছের চারা রোপণ করে আসছে। সব উপকারভোগীই কাঠজাতীয় বৃক্ষ রোপণে অতি উৎসাহী এবং কাঠজাতীয় গাছের চারাই রোপণ করে থাকেন। কাঠজাতীয় বৃক্ষ অল্প সময়ে বড় হয় এবং মেয়দান্তে উপকারভোগীরা যে অংশ পান তাতে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু আর্থিক লাভের দিকে না তাকিয়ে জব্বার মিয়া ও ইমরান মিয়া এলাকার সাধারণ মানুষের উপকারের কথা চিন্তা করে কাঠজাতীয় গাছের চারা রোপণ না করে পুরো ৪ কিলোমিটার রাস্তার দু'পাশে তিন লাইন করে মোট ৫ হাজার ভেষজ বৃক্ষ অর্জুন গাছের চারা রোপণ করেন। ২০ বছর পূর্বে জব্বার মিয়া ও ইমরান মিয়া কর্তৃক রোপণকৃত ভেষজবৃক্ষ অর্জুনের শতভাগ গাছই জীবিত আছে। একটি গাছও মরে যায়নি বা কোনো গাছ চুরিও হয়নি। এলাকার ইমরান মিয়া জানান, তাদের রোপণকৃত ঔষধি সড়কের অর্জুন গাছগুলো ২০০৬ সালেই পরিপক্ক হয়েছে। তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদও ওই বছরেই শেষ হয়েছে। তথাপিও তারা অর্জুন গাছগুলো সযত্নে আগলে রেখেছেন। তিনি জানান, এই গাছগুলো থেকে প্রতিদিন এলাকার শত শত মানুষ গাছের ছাল নিয়ে যাচ্ছেন। এসব গাছের দ্বারা এলাকার মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। তাই তারা নিজেদের লাভের চিন্তা মাথায় না এনে এলাকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে গাছগুলো আগলে রাখতে চান। তবে কোনো আয়ুর্বেদী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গাছগুলো ক্রয় করতে চাইলে তারা দিতে প্রস্তুত আছেন বলে জানান।
এলাকার প্রবীণ মুরব্বী সামছুল ইসলাম জানান, কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি চা বাগান থেকে ভানুগাছ বাজারসংলগ্ন পুরাতন ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার অর্জুন গাছ দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হলে তিনি খুশি হবেন। তিনি বলেন, 'গত তিন দশক পূর্বেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ মানুষ রোগে-শোকে বনাজী ও গাছ-গাছড়ারই তৈরি ওষুধই ব্যবহার করতেন। বর্তমান সময়ে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং বর্তমান প্রজন্ম আয়ুর্বেদী চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না পাওয়ার কারণে ঔষধি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটিকে রক্ষা করতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে আয়ুর্বেদী চিকিৎসা পদ্ধতিকে।' মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ জানান, কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি থেকে ভানুগাছ বাজার সংলগ্ন ব্রিজ পর্যন্ত সড়কটিকে এলাকার মানুষ ঔষধি সড়ক হিসেবে চেনে। সড়ক ও জনপদের রাস্তার উপর সামাজিক বনায়নে ঔষধি বৃক্ষ রোপণ এবং ওই বৃক্ষের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রবীণ ব্যক্তিরা জ্ঞাত থাকায় ওই সড়কের আশপাশের প্রায় ১০ গ্রামের মানুষ আবারো ফিরে গেছেন সেই আদি যুগে। এছাড়া এলাকাটি পুরো মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মৌলভীবাজার জেলায় আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এ সড়ক দেখে মুগ্ধ হন। ছায়াঘেরা এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করলে ভালো লাগার আবেশ বয়ে যায় মনে-প্রাণে।