সবুজ ক্ষেতে সোনার ফসল-দেশি সবজির বিদেশি বাজার

যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাঠি মাঠে দেড় বিঘা জমিতে পটোলের চাষ করেছেন মোবারেক হোসেন। ভর-দুপুরে মাথায় গামছা বেঁধে সেই ক্ষেত থেকে আগাছা পরিষ্কার করছেন তিনি। বললেন, আরও তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছিলেন আলু, লালশাক, সবুজশাক আর মিষ্টি কুমড়া। ফলন ভালোই হয়েছে। পাটকাঠি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি মাচায় তার পটোলের গাছ উঠতে শুরু করেছে। মোবারেক হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে পটোলের চাষ করতে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। পটোল ধরতে শুরু করলে এক বিঘা জমি থেকে সপ্তাহে ১৫ মণ পটোল পাওয়া যায়। এভাবে চার মাসে প্রায় এক লাখ টাকার পটোল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। সারা বছর সবজি চাষের মধ্যেই থাকেন মোবারেক হোসেন। তিনি বলেন, সারা বছর সবজি চাষ করেই তারা সচ্ছলভাবে জীবন-যাপন করেন। এক বিঘা শিম চাষে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। আর এই জমি থেকে পাওয়া যায় ৩ হাজার কেজি শিম। তিনি আরও জানান, এক বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করতে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। এখান থেকে ৪০ হাজার টাকার বাঁধাকপি বিক্রি করা যায়। একই ভাবে ২৫ হাজার টাকা খরচ করে এক বিঘা জমি থেকে বেগুন পাওয়া যায় ২৮০ মণ, যার দাম ৫০ হাজার টাকারও বেশি।

 

সবজি চাষের জন্য উঁচু ভূমি, আর বেলে-দোআঁশ মাটি দরকার হয়। যশোর সদর উপজেলার সাতমাইল-বারিনগর আর বাঘারপাড়া উপজেলার বেশির ভাগ অংশই সবজি চাষের জন্য আদর্শ। আর সে কারণেই এলাকাগুলোতে চাষিরা প্রায় সারা বছরই নানা রকমের সবজি চাষ করে থাকেন। এসব এলাকার চাষিরা জানান, তারা সাধারণত ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক, লালশাক, সবুজশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, চাল কুমড়া, টমেটো, মুলা, বরবটি, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, ঢেঁড়স, শিম, চিচিঙ্গা, ঝিংগা, করলা, উচ্ছে, গাজর, শালগম, ওলকপি, ভাটিশাক, ক্ষিরা, পেঁপে, কাঁচকলা, মানকচু, মেটে আলু, লতিরাজ, পানিকচুসহ অন্তত ৩৫ রকমের সবজির চাষ হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি শীত মৌসুমে যশোরে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে অন্তত ৩০ রকমের সবজি চাষ করা হয়েছে। যেখান থেকে পাওয়া যাবে প্রায় সোয়া ৫ লাখ মেট্রিক টন সবজি। চাষিরা এসব সবজির দাম গড়ে ২০ টাকা করে পেয়ে থাকেন। সে হিসাবে এবার যশোরের চাষিরা এক হাজার কোটি টাকারও বেশি সবজি বিক্রি করবেন। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, যশোর ও আশপাশের এলাকায় মোট সবজির চাহিদা তিন লাখ মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক শেখ হেমায়েত হোসেন বলেন, যশোরে এত বেশি সবজি উৎপাদন হয় যে, এই এলাকাকে সবজি জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চাষিদের নানারকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নত মানের সবজি উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছেন।

 

জানা গেছে, দেশের কৃষি অর্থনীতিতে যেখানে সবজির অবদান ১০ থেকে ১১ ভাগ, সেখানে যশোরে কৃষি অর্থনীতিতে সবজির অবদান ৩০ ভাগেরও বেশি। একসঙ্গে যখন অনেক বেশি সবজি বাজারে উঠতে থাকে, তখন দাম পড়ে যায়। সে সময় চাষিরা যদি সবজি হিমাগারে রাখতে পারতেন, অসময়ে সেগুলো বিক্রি করে লাভবান হতে পারতেন। সম্প্রতি যশোরের বারিনগর-চুড়ামনকাঠি এলাকার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা তাদের ক্ষেতের সবজিতে দেদার কীটনাশক স্প্রে করছেন। তাদের বক্তব্য বেশির ভাগ সময় ক্ষতিকারক পোকা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, কীটনাশক ব্যবহার করা ছাড়া উপায় থাকে না। তাহলে এক দশক আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সৈয়দ নুরুল আলম ক্ষতিকারক কীট দমনে 'ফেরোমেন ট্রাপ' নামে যে যুগান্তকারী পদ্ধতি যশোরের সবজি চাষিদের চিনিয়েছিলেন, তা কি কোনো কাজে আসছে না? কৃষক সংগঠন আইউব হোসেন বলেন, ফেরোমেন ট্রাপ কৃষকের কাছে আরও সহজলভ্য করার পাশাপাশি তাদের এ বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগও নিতে হবে। প্রতি বছর যশোর ও আশপাশের এলাকার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও সবজি রপ্তানি হচ্ছে।



HTML Counter © ২০১৩ আলোকিত গ্রামবাংলা
Powered by Ipsita Soft
Loading... Please wait...